প্রাণ ঢেকে যায় দূষণে
দূষিত জলের ঘ্রাণ এসে নাকে কড়া নেড়ে জানিয়ে দিল, ঢাকার কাছাকাছি জলযান। এই ঘ্রাণ অপরিচিত নয়। বুড়িগঙ্গার চৌহদ্দির মধ্যে এলেই পচা জলের গন্ধ শুধু নাকে নয়, যেন পুরো শরীরকেই জড়িয়ে নেয়। বুড়িগঙ্গার কাছ থেকে দৌড়ে যত দূরেই যান জলের দুর্গন্ধ আপনাকে ছাড়বে না। অথচ এই বুড়িগঙ্গাকে যখন প্রথম দেখি, তখন এর জল হয়তো ঘোলা ছিল, কিন্তু রঙ এমন আলকাতরার মতো কালো ছিল না।
বুড়িকে ছোঁয়া যেত। জলে মুখও ধুয়ে নিয়েছি বার কয়েক। ধীরে ধীরে সেই জলের মৃত্যু ঘটল। জীবমৃত্যুর রূপ নিলো বুড়িগঙ্গা। নিজের প্রাণ মুমূর্ষু হওয়াতে, বুড়িগঙ্গা এখন কোনো প্রাণ তার বুকে ঠাঁই দিতে পারে না।
বুড়িগঙ্গাকে হত্যা করলো কে? এই নদীকে ঘিরে আমরা যারা নগর গড়েছি। ঢাকাকে দিয়েছি তিলোত্তমার সাজ। তারাই তিলে তিলে হত্যা করছি বুড়িগঙ্গাকে। ঢাকার বৈভব বুঝাতে আমরা আহাম্মকের মতো যেসব দেশের সঙ্গে তুলনা দেই, তারা নদীকে যেমন আদর করে বাঁচিয়ে রেখেছে, বিত্তের অংশ করে নিয়েছে।
আমরা এক তিল পরিমাণও সেই কাজ করতে পারিনি। দখল-উচ্ছেদ খেলা খেলে কিছু শিশু ভুলানিয়া গল্প হচ্ছে। কিন্তু তাতে বুড়িগঙ্গার মুখে হাসি ফুটেনি। আমরা একই সঙ্গে শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ বংশীকেও বর্জ্যের ভাগাড় করেছি।
বুড়িগঙ্গাকে হত্যা করলো কে? এই নদীকে ঘিরে আমরা যারা নগর গড়েছি। ঢাকাকে দিয়েছি তিলোত্তমার সাজ। তারাই তিলে তিলে হত্যা করছি বুড়িগঙ্গাকে।
নদী ছাড়াও ঢাকার অন্য জলাধারগুলো বর্জ্যে হারিয়ে গেছে। শুধু কি ঢাকা? উৎপাদন ও উন্নয়নের বর্জ্যের দূষণে আক্রান্ত দেশের প্রায় সব নদী। নদীর উপরিভাগের জলই শুধু নয়, আমরা মাটির নিচের জলকেও শুদ্ধ রাখিনি। দূষণের শিকার তলদেশে প্রবাহিত জলও।
বাম্পার জনসংখ্যার আহার জোটাতে গিয়ে, মাটিতে বিষ ঢেলে দিচ্ছি আমরা। সেই বিষ শুধু যে মাটিকে দূষিত করছে তা নয়, বিষ মিশে যাচ্ছে খাবারে।
আমাদের প্লাস্টিক সভ্যতা, প্রবেশ করেছে আমাদের অন্দরে। জায়গা করে নিচ্ছে শরীরের কোষে কোষে। মাটির দূষণ, জলের দূষণে আমাদের দেহও এখন দূষণাক্রান্ত। শরীর এখন আর মহাশয় নেই। দূষণের শরীর সইবার ক্ষমতা হারিয়েছে। জল, মাটির পাশাপাশি আমাদের বসবাস এখন বায়ু দূষণের সঙ্গে।
বায়ু দূষণে শীর্ষে পৌঁছে গেছি আমরা। ২০০০ সালের দিকে আমরা বলতাম শহরের দূষণের জন্য টু স্ট্রোক স্কুটার, ডিজেলের দূষণ দায়ী। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস এলো, টু স্ট্রোক সড়ক থেকে চলে গেল। কিন্তু বায়ু দূষণ কিন্তু কমেনি।
অপরিকল্পিত নির্মাণ, নির্মাণ কাজের নীতি না মেনে চলা, ইটভাটা, মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহন রেখে দেওয়ায়, মাঠে-পথে বায়ুর দূষণ বাড়ছেই। বায়ু দূষণ বাড়ায় অসংক্রামক ব্যাধি বাড়ছে। ঢাকা হয়ে পড়েছে বসবাসের অনুপযোগী।
শুধু ঢাকা নয় সারাদেশেই শব্দ সন্ত্রাস চরমে পৌঁছেছে। নগরায়নের সঙ্গে উপজেলা, জেলায় পৌঁছেছে যানজট। পরিবহনের হর্ন সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে। শুধু কানের রোগই নয়, হৃদযন্ত্রসহ শরীরের আরও বিবিধ রোগের কারণ শব্দ দূষণ।
হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা ‘ভেঁপু বা হর্ন বাজানো নিষেধ’ নির্দেশনাগুলো এখন পরিহাস, রসিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু ঢাকা নয় সারাদেশেই শব্দ সন্ত্রাস চরমে পৌঁছেছে। নগরায়নের সঙ্গে উপজেলা, জেলায় পৌঁছেছে যানজট। পরিবহনের হর্ন সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে।
কোনো আইন, কোনো নিয়মে হর্ন বাজানো থেকে চালকদের বিরত রাখা যাচ্ছে না। শহরের আবাসিক এলাকার সম্ভ্রম রাজউক, সিটি করপোরেশন রক্ষা করতে পারেনি। ফলে আবাসিক এলাকা বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকায় রূপ নেওয়াতে শব্দ দূষণ পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে।
যে বাহ্যিক দূষণের কথা বলা হলো, তার কারণ হলো নৈতিক দূষণে আমাদের সমৃদ্ধি। নৈতিক ভাবে আমাদের অবক্ষয় ঘটার কারণেই নদী হত্যা করছি। নদীতে ঢেলে দিচ্ছি বর্জ্য। মাটি, বাতাস করছি দূষিত।
আমাদের নৈতিক পরিশোধন যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ দূষণ থেকে মুক্ত হওয়ার পূর্বাভাস আপাতত দেওয়া যাচ্ছে না। বরং সামনে আরও মুমূর্ষু পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার পূর্বাভাস পাচ্ছি।
কেন পরিশোধনের সম্ভাবনা দেখছি না? কারণ হলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা অনৈতিক বা অসৎ কাজ, চিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি। লোভাতুর হয়ে পড়ছি দিনকে দিন। প্রকৃতি বাঁচলেই শুধু আমরা বাঁচবো, এই বোধ হারিয়ে ফেলেছি।
ব্যক্তির লোভ হয়ে উঠছে সামগ্রিক। সামগ্রিক লোভ হজম করে নিচ্ছে প্রকৃতিকে। আইন কম হচ্ছে না। সেমিনারের কমতি নেই। কিন্তু কাজের কাজটি না হওয়ার কারণ আত্মপ্রতারণা।
প্রতিবাদকেও আমরা বাণিজ্য হিসেবে দেখছি। প্রকৃতি হত্যাকারীদের সঙ্গে করছি গোপন আঁতাত। আমাদের প্রকৃতি প্রেম ও প্রতিবাদে বিশুদ্ধতা না আসলে, দূষণমুক্ত বাংলাদেশ উদযাপনের সম্ভাবনা যে দেখতে পাই না।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী