সত্যেন সেন : মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের তূর্যবাদক
সত্যেন সেন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকেই গণসংস্কৃতি চর্চার পথ বেছে নেন। আর তাই সংগঠন চিন্তা ছিল তার শিরায় শিরায়, রক্তপ্রবাহে। সত্যেন সেন মনে করতেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোনো স্লোগান, বক্তব্য বা দর্শনকে অতি সহজেই মানুষের মনের গভীরে পৌঁছে দেওয়া যায়। যে কারণে তার রাজনৈতিক চর্চার প্রতি পরতে পরতে আমাদের কাছে মূর্ত হয়ে ধরা পড়েছে সাংস্কৃতিক অভিঘাত। তিনি অবিভক্ত বাংলা সাহিত্যের প্রগতিবাদী লেখককুলের অন্যতম।
কৃষক আন্দোলন তথা শ্রমজীবী মানুষের প্রগতিশীল রাজনীতি, উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে তিনি গণমানুষের গণসংগ্রামের ধারায় নিতে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন সমাজ প্রগতির সংগ্রামে।
১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আজীবন নিজের পাঁজর পুড়িয়ে আলো ছড়িয়ে ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার স্মৃতির প্রতি আভূমিনত শ্রদ্ধা।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় জীবনের একটা বড় সময় জেলের অভ্যন্তরে কাটান তিনি। শুধু পাকিস্তানি শাসনের ২৩ বছরের মধ্যে প্রায় ১৩ বছরই সত্যেন সেন কারান্তরালে কাটিয়েছেন। তবে আত্মগোপন বা কারাবাস কোনোকিছুই তাকে মানুষের মুক্তিসংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে পারেনি।
পঞ্চাশের দশকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর জেল-জুলুম, অত্যাচারের ফলে গণআন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লে সেই স্তব্ধপ্রায় আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে তিনি কারাগারের মধ্যে থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিকে বেশি জোর দেন।
কৃষক আন্দোলন তথা শ্রমজীবী মানুষের প্রগতিশীল রাজনীতি, উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে তিনি গণমানুষের গণসংগ্রামের ধারায় নিতে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন সমাজ প্রগতির সংগ্রামে।
তিনি কেবলই সাহিত্যিকের খাতায় নাম লেখানোর জন্য সাহিত্য রচনা করেননি। সংগ্রামী জীবনের দায়িত্ব পালনের জন্য মেহনতি মানুষের সংগ্রাম ও সমাজ প্রগতির সংগ্রামকে শাণিত করে তোলার জন্য সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত হয়েছিলেন।
১৯৪২ সালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের আরেক পথিকৃৎ সোমেন চন্দ নিহত হওয়ার পর তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সঙ্গে। ১৯৪৬ সালে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট জননেতা কমরেড ব্রজেন দাশের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি কবিয়াল দল।
১নং ঢাকেশ্বরী মিলের একটি অপেশাদারি দলকে পেশাদারি দলে রূপায়িত করেছিলেন। এ দলটি মিলের শ্রমিকদের উদ্যোগে এবং নিজেদের প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশ্য নিয়েই গড়ে উঠেছিল। এই দল নিয়েই সত্যেন সেন ব্রজেন দাশের নির্বাচনী প্রচারণা সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন।
সত্যেন সেন এই দল এবং তার গঠন সম্পর্কে ‘কবিগানের দল’ শিরোনামে লেখাটির মধ্যে বলেছেন, ‘এই কবিগানের দল- আমি কেমন করে এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম? আমার বন্ধুরাই বা আমাকে মনোনীত করলেন কেন? একেবারে অকারণে নয় তো। আমি যদিও তখন ঢাকা শহরের অধিবাসী, তবু এই অঞ্চলের শ্রমিকদের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগের সূত্র ছিল। ট্রেড ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে নয়, জনসংস্কৃতির একজন সেবক হিসেবে। সেই হিসেবেই মাঝে মাঝে তাদের দেখবার, শুনবার এবং তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশবার কিছু কিছু সুযোগ পেতাম। সেজন্য নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করতাম। এখনো তাই মনে করি। তাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হতো আমার মনের ধমনিতে যেন নতুন রক্তের সঞ্চার শুরু হয়ে যেত। আর যখন চলে আসতাম তখন নতুন প্রেরণা নিয়ে নতুন হয়ে ফিরে আসতাম।’
তার এই কবি গানের দল সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সুনীল রায় বলেছেন, ‘আমি দেখেছি তাকে রাত জেগে ঢাকেশ্বরী মিলের শ্রমিকদের নিয়ে কবিগানের দল করতে। এভাবে তিনি শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষদের নিয়ে গণজাগরণমূলক শ্রেণিসংগ্রামের গানের দল ও লোককবির দল গঠন করে তাদের নিয়ে বিভিন্ন শ্রমিক এলাকায় ঐ সাড়া জাগানো গান গেয়ে আন্দোলন ও সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেন।’
এ দলটি বিভিন্ন অঞ্চলে কবিগান পরিবেশন করে বেড়াত। তারা অন্যের লেখা গান যেমন গাইতেন তেমনিভাবে এদের মধ্যেও কয়েকজন গান লিখতে পারতেন। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার প্রত্যক্ষ অনুভূতিকে তারা গানের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতো। সেইসব গান তাদের মুখে মুখে ফিরত।
প্রত্যাশা ছিল সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত মেহনতি মানুষের পাশে থেকে উদীচী পথ দেখাবে, বয়ে আনবে নতুন ঊষার নববারতা। তার সে স্বপ্ন বিফলে যায়নি। তারই প্রতিষ্ঠিত উদীচী আজ দেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এরপর ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কারাজীবনের বাইরে যতটুকু থাকার সুযোগ হয়েছে সে সময়েই তিনি যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। তিনি যুক্ত হয়েছেন ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সৃজনী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে। ‘সত্যেন সেন রচনা সমগ্র’ প্রথম খণ্ডের ভূমিকা লিখতে গিয়ে তার অন্যতম সহযোগী রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘তিনি মূলত কৃষক ও মজুরদের আন্দোলনকে ভিত্তি করে গণসংগীত রচনা করে সংঘের সংগীতের ধারার অন্যতম প্রবক্তা হয়ে উঠেন। তার এই দিকটা ’৬৮-‘৬৯ সালে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ‘উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ গঠনের মধ্য দিয়ে সার্থক হয়ে উঠে।’
প্রকৃতপক্ষে কারামুক্ত হওয়ার পর ’৬৮ সালের প্রথম দিক থেকেই সত্যেন সেন প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার। কিন্তু এ সংগঠনের প্রথম দিনের সংগীত শিক্ষণই বন্ধ হয়ে যায় বাড়িওয়ালার ধমকে। তবু চেষ্টা চলতে থাকে অবিরাম।
অবশেষে ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকেই শিল্পী সাইদুল ইসলামের নারিন্দার বাসায় ‘ওরে ওরে বঞ্চিত সর্বহারা দল’ গানের মহড়ার মধ্য দিয়ে ‘উদীচী’র যাত্রা শুরু হয়। অবশ্য আরও পরে, ঢাকার গোপীবাগের একটি বাড়িতে বসার জায়গা পাওয়ার যায়। তারও কিছু পরে চামেলীবাগের পীর হাবিবুর রহমানের মেসে মহড়া চলাকালীন সত্যেন সেন সংগঠনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, ‘উদীচী’; উত্তর আকাশের ধ্রুবতারা।
প্রত্যাশা ছিল সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত মেহনতি মানুষের পাশে থেকে উদীচী পথ দেখাবে, বয়ে আনবে নতুন ঊষার নববারতা। তার সে স্বপ্ন বিফলে যায়নি। তারই প্রতিষ্ঠিত উদীচী আজ দেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন। দেশে এবং বিদেশে প্রায় তিনশতাধিক শাখা গণমানুষের সংস্কৃতি বিকাশে শিল্পকলার সকল মাধ্যমে ভূমিকা রেখে চলেছে।
মুক্তিযুদ্ধের উদ্ভবপর্ব থেকে শুরু করে গত ৫৪ বছর ধরে উদীচী সত্যেন সেন প্রদর্শিত এই বিশেষ ধারাটি পরম স্নেহে পরিচর্যা করে চলেছে। তার সাহিত্য, সংগীত এবং সংগ্রামের উত্তরাধিকার বহন করে মেহনতি মানুষের সংগ্রামে উদীচী থাকবে সদা জাগ্রত। সত্যেন সেন বেঁচে থাকবেন এ সকল সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে।
অমিত রঞ্জন দে ।। সংস্কৃতিকর্মী ও সহ-সাধারণ সম্পাদক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ