বায়ু দূষণের শীর্ষে বাংলাদেশ : করণীয় কী?
বায়ু দূষণ বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
২০২১ সালের বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর মাত্রা ৭৬.৯। এর মাত্রা ১০–এর নিচে হলে তা ক্ষতিকর নয় বলে বিবেচনা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
বায়ুমান সূচক ২০২০ অনুযায়ী, শীর্ষ দূষিত ১০০ শহরের মধ্যে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ঢাকার আজিমপুর ও গাজীপুরের শ্রীপুরের অবস্থান যথাক্রমে ১৬, ২৩, ৬০ ও ৬১ নম্বরে।
ঢাকার চারপাশের ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো এবং ঢাকা নগরীর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ি; রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ; মেরামতহীন ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে অতি মাত্রায় বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার নির্গমন, ভবন নির্মাণ ও ভাঙার সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী বাইরে রাস্তা-ফুটপাতে যত্রতত্র ফেলে রাখা, মেশিনে ইট-পাথর ভাঙা এবং শিল্প-কারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালি বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত ক্ষতিকারক গ্যাস, ভারীধাতব কণা ও ধুলাবালি বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সাম্প্রতিক কালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ২.৫ মাইক্রোমিটার আকৃতির ভাসমান বস্তুকণা যথাক্রমে—ফার্মগেট, দারুস সালাম, সংসদ ভবন, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ৮৪.৫৩, ৮০.৪৪, ৬৩.৯০, ৯৪.০৫, ৬১.৬৭ ও ৭৮.৭৮। যার সহনীয় পরিমাণ হচ্ছে, ৫০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনফুট। উপরন্তু ঢাকার বাতাসে ক্যাডমিয়াম প্রায় ২০০ গুণ বেশি, নিকেল ও সিসার মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ ও ক্রোমিয়াম প্রায় ৩ গুণের বেশি।
বায়ুমান সূচক ২০২০ অনুযায়ী, শীর্ষ দূষিত ১০০ শহরের মধ্যে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ঢাকার আজিমপুর ও গাজীপুরের শ্রীপুরের অবস্থান যথাক্রমে ১৬, ২৩, ৬০ ও ৬১ নম্বরে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮%, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮%, যানবাহন ১০%, বায়োমাস পোড়ানো ৮% এবং অন্যান্য উৎস ৬% দায়ী। একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক গড়ে ২,০০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ থেকে ক্যান্সার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। ২০২১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার মৃত্যুর সরাসরি কারণ বায়ু দূষণ। সম্প্রতি সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) নামক রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এ রোগটি বাংলাদেশে মৃত্যুর তৃতীয় কারণ। এ রোগের সঙ্গে বায়ু দূষণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বায়ু দূষণে ঢাকাবাসীর আয়ু কমেছে সাড়ে ৭ বছর। অতিরিক্ত বায়ু দূষণের খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর।
মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্যই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে—এটি এখন এক কঠিন সত্য। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসে মিশছে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে প্রধান গ্রিনহাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বার্ষিক গড় দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৮৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বিগত এক দশকে (২০১১-২০) ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০-এর চেয়ে ১.০৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের কর্মকাণ্ডই পৃথিবীর জল, স্থল ও বায়ুমণ্ডলকে আশঙ্কাজনকভাবে উত্তপ্ত করে তুলছে।
আবার প্রযুক্তি পণ্যের উচ্ছিষ্ট বর্জ্যগুলো মাটি, বায়ু ও পানিকে দূষিত করছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক অভিঘাত বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য ভূপৃষ্ঠের অবনয়ন ঘটছে, যার নেতিবাচক অভিঘাত পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছে জীববৈচিত্র্যের মহাবিলুপ্তির দিকে।
বর্তমান সরকার এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) ও ভালনারেবল টোয়েন্টি (ভি২০) গ্রুপের চেয়ার হিসেবে বর্তমানে কাজ করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবিলা ও সবুজ উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ তৈরি করা হয়েছে। কপ-২৬-এর অভীষ্ট অর্জনে সিভিএফ ও ভি ২০-এর প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের এই কর্মকাণ্ড প্রশংসার দাবি রাখে। কয়লা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় কয়লা ভিত্তিক কয়েকটি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।
একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক গড়ে ২,০০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ থেকে ক্যান্সার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য নির্মল ‘বায়ু আইন ২০১৯’ এর প্রয়োগ, সবুজ আন্দোলনসহ নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি।
• ত্রুটিপূর্ণ ও কালো ধোঁয়া উৎপাদন করে এমন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করা।
• ইটের ভাটা লোকালয় থেকে দূরে স্থাপন করা। পুরনো পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা।
• কম জ্বালানি ব্যবহার হয় এমন উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
• ধূমপান না করা।
• উন্নত চুলা ব্যবহার করা।
• বনভূমি সংরক্ষণ করা ও নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা।
• সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বায়ু দূষণের পরিমাণ বাইরের বায়ু দূষণের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। এসি ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
• সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ বহিরঙ্গের বায়ু দূষণের চেয়ে অধিকমাত্রায় বেশি। তাই বায়ুমান নিশ্চিত করা জরুরি।
• বায়ু দূষণের কারণে রোগাক্রান্তদের সুচিকিৎসার জন্য সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
• সবুজ করের প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে। এর মূল নীতি হবে ‘যারা কলুষিত করবে বা দূষণ করবে, তারা বেশি কর প্রদান করবে।’
• অতিমাত্রায় দূষিত বায়ুর শহরগুলোতে ‘স্মগ টাওয়ার’ স্থাপন করা যেতে পারে।
• নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই বায়ু দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। বায়ু দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এ অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের সংবেদনশীল হতে হবে এবং পরিবেশের প্রতি যত্নশীল থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে হবে।
উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল নীতিমালায় পরিবেশের বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে এবং পরিবেশ নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই আমাদের পরিকল্পনা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বায়ু দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা আবশ্যক।
ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]