পিএইচডি ডিগ্রি কেন জরুরি?
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটি হলো অধ্যাপক এমনকি সহযোগী অধ্যাপক হতে গেলেও শিক্ষক, গবেষকদের পিএইচডি ডিগ্রি অবশ্যই লাগবে। তবে এইটা কেবল শুরু। এইটা আরও অনেক আগে নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে আমরা এখন এর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে পারতাম।
শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং যোগ্যতায় দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। যেটুকু এসেছে তাতে আরও আমরা পিছিয়েছি। যেমন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অধ্যাপক হওয়ার জন্য আলবার্ট আইনস্টাইন সুপারিশ পত্র পাঠিয়েছিলেন। এই চিঠির কারণে সত্যেন্দ্রনাথ বসু পিএইচডি না থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক হয়েছিলেন। অর্থাৎ ব্যতিক্রমী মানুষের ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্ৰম ঘটানোও একটি নিয়ম।
এমনিতেও শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রমোশনের ক্ষেত্রে তখন দেশ বিদেশের বিখ্যাত শিক্ষকদের মতামত নেওয়ার একটা প্রচলন ছিল যা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত নতুন এই নিয়ম একটা ভালো শুরু হিসেবে দেখা উচিত এবং এইজন্য কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারে।
প্রভাষক পদ হওয়া উচিত অস্থায়ী, যার ন্যূনতম যোগ্যতা মাস্টার্স হতে পারে। কিন্তু দিন শেষে স্থায়ী পদ এবং সহকারী অধ্যাপক হতে পিএইচডি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
সারা বিশ্বে এমনকি ভারতীয় প্রযুক্তিক প্রতিষ্ঠান বা ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) এবং ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থা (আইআইএসসি) প্রভৃতি সব বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে সহকারী অধ্যাপক হতে কেবল পিএইচডি-ই যথেষ্ট নয়, ক্ষেত্র বিশেষে একাধিক পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতাও লাগে। বর্তমান সিদ্ধান্তে আমাদের ছাত্ররা যারা বিদেশে পিএইচডি করছে তারা ফিরে আসতে উৎসাহিত বোধ করবে।
পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে ভালো শিক্ষক না হলেও অনেক ক্ষেত্রে তিনি ভালো গবেষক হয়ে উঠতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান সৃষ্টি করা। পিএইচডি ডিগ্রি গবেষক হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় ট্রেনিং।
অনেকে প্রশ্ন তোলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি কেন লাগবে? অনেকে উদাহরণও দিতে পারবেন যে, পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে অনেকে ভালো শিক্ষক বা ভালো গবেষক নন। এমন উদাহরণও আছে যে, পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়াও অনেকে ভালো পড়ায়। এইগুলো খুব কাজের উদাহরণ নয়।
একজন মানুষ পিএইচডি বিহীন কিংবা পিএইচডি ডিগ্রিসহ ভালো কিংবা খারাপ শিক্ষক হতে পারেন। তবে যিনি মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে খারাপ শিক্ষক, তার পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে একটু না একটু ভালো শিক্ষক হবেনই। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিগুলো যেমন বিএস, এমএস, পিএইচডি ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের কিছুটা হলেও উন্নতি হয় যা এইসব ডিগ্রি না থাকলে হতো না।
পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে ভালো শিক্ষক না হলেও অনেক ক্ষেত্রে তিনি ভালো গবেষক হয়ে উঠতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান সৃষ্টি করা। পিএইচডি ডিগ্রি গবেষক হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় ট্রেনিং।
সবার কি পিএইচডি ডিগ্রি দরকার? একদমই না। যারা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন পিএইচডি ডিগ্রি তাদের জন্য অবশ্যই জরুরি। বাকি যারা পিএইচডি করেন তাদের অধিকাংশই নামের আগে একটি অর্নামেন্ট স্বরূপ ‘ডক্টরেট’ জুড়ে দেওয়ার জন্য পিএইচডি করেন।
পিএইচডি শেষে তারা কোনো জ্ঞান সৃষ্টি করেন না কিংবা তাদের লব্ধ জ্ঞান ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টিতে কোনো কাজে লাগে না। পিএইচডি করতে ন্যূনতম ৩ বছর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৭ বছর লাগে। অর্থ এবং সময়ের এই বিনিয়োগ তখনই কাজে আসবে যখন পিএইচডি ডিগ্রি শেষে এই অভিজ্ঞতাকে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি বা নতুন প্রজন্ম তৈরিতে ব্যয় করা হবে।
বাংলাদেশে অনেকেই অপ্রয়োজনীয়ভাবে পিএইচডি করেন। অপ্রয়োজনীয় পিএইচডি হলো সেইগুলো, যেই ডিগ্রি অর্জনের পেছনে কোনো একাডেমিক কারণ নেই। আছে কেবল সামাজিক কারণ। বাংলাদেশে অনেকেই পিএইচডিকে এখন বিবেচনা করছেন সামাজিক মর্যাদা লাভের হাতিয়ার হিসেবে।
অনেক সরকারি চাকরিজীবী আছেন যারা ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সে পিএইচডি করতে যান। অথচ পিএইচডি করার জন্য মাস্টার্স যেদিন শেষ হয় তারপরের দিনই শ্রেষ্ঠ সময়। এরপর দিন যত যায় ততই পিএইচডি-র জন্য অনুপযোগী হয়, বিশেষ করে তিনি যদি একাডেমিক কারিকুলামে না থাকেন।
অপ্রয়োজনীয় পিএইচডি হলো সেইগুলো, যেই ডিগ্রি অর্জনের পেছনে কোনো একাডেমিক কারণ নেই। আছে কেবল সামাজিক কারণ। বাংলাদেশে অনেকেই পিএইচডিকে এখন বিবেচনা করছেন সামাজিক মর্যাদা লাভের হাতিয়ার হিসেবে।
৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সে পিএইচডি করতে গিয়ে ৪৪ থেকে ৫৪ বছর বয়সে পিএইচডি শেষ করে ফিরে আসলে তার পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে জাতি কতটা উপকৃত হবে? পিএইচডি কোনো শখের জিনিস না। এটা অত্যন্ত কষ্টের একটা ডিগ্রি। এই সময় একজন শিক্ষার্থী নাওয়া খাওয়া ভুলে কেবল গবেষণার বিষয় নিয়ে ভাবেন। তবে বাঙালি এই ডিগ্রির ফলে নামের আগে ডক্টরেট লাগিয়ে নিজেকে জাহির করে তার চারিত্রিক হীনম্মন্যতাকেই প্রকাশ করেন।
ট্যাক্সের টাকা খরচ করে বাংলাদেশ সরকারের অবশ্যই উচিত নয় দেশের শিক্ষক আমলাদের বিদেশে পাঠিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি করানো। যাদের যোগ্যতা আছে তারা যেই দেশে পড়তে যাবে সেই দেশের বা সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ বা ফেলোশিপ নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাই করেন।
সরকার যাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে বিদেশে পিএইচডি করতে পাঠায় তাতে লাভ হয় যেই দেশে পাঠায় এবং যেই প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করে তাদের। সেই জন্যইতো তারা স্কলারশিপ ও ফেলোশিপ দেয়। ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশ জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে অন্য দেশে পিএইচডি করতে পাঠায়? বরং আমাদের যেটা করা উচিত সেটা হলো ওই টাকা দিয়ে নিজ দেশে ইন্সটিটিউট তৈরি করে সেখানে দেশ বিদেশ থেকে বিশ্বমানের গবেষক ও পোস্ট-ডক নিয়োগ দিয়ে দেশেই পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা। তাতে দেশে গবেষণার একটা পরিবেশ তৈরি হবে।
নিজ দেশে আন্তর্জাতিক মানের গবেষকরা যত বেশি থাকবে দেশের মানও তত বৃদ্ধি পাবে। এরাই আসলে দেশের বড় বড় দূত হয়। এদের মাধ্যমে বিশ্ব আমাদের দেশকে চিনবে এবং সম্মান বাড়াবে।
বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচারের প্রকাশনা নেচার ইনডেক্স (Nature Index) নামে কিছু ডাটা প্রকাশ করে। এইরকম একটি ডাটা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে গবেষণা বিবেচনায় একটি র্যাঙ্কিং করেছে। সেই র্যাঙ্কিং-এ গবেষণায় বিশ্বে এক নম্বর দেশ আমেরিকা, দুই নম্বরে আছে চীন, ১১ নম্বরে আছে ভারত, ৪৬ নম্বরে পাকিস্তান আর ৭৪ নম্বরে বাংলাদেশ।
আমরা অর্থ সম্পদে যতই এগিয়ে থাকি না কেন জ্ঞান, বিজ্ঞান ও গবেষণায় না আগালে অশিক্ষিতের বেশি অর্থ হওয়ার মতো অবস্থা হবে। আমাদের দেশের রাস্তা ঘাট, পরিবেশ, ট্রাফিক ব্যবস্থা, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি সবকিছুই প্রমাণ করে যে আমাদের কেবল টাকাই হয়েছে রুচি হয়নি, সংস্কৃতিবোধ ইত্যাদিতে পিছিয়েছি। এই অবস্থা থেকে উন্নতির উপায় কী?
উপায় হলো, দেশে বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্বমানের কিছু ইন্সটিটিউট করা। তবে ইন্সটিটিউট করে সেখানে যদি আবার আমলা আর রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাহলে বিদ্যমান ইন্সটিটিউটগুলোর মতোই হবে। উন্নতি আর হবে না। এমন ইন্সটিটিউট করতে হবে যেখানে গবেষণার জন্য বিশ্বমানের সুবিধা, মনোরম পরিবেশ, থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা এবং বিশ্বমানের গবেষকদের নিয়োগ দিতে বিশ্বমানের বেতন ভাতা দিতে হবে। আশা করি সরকার এই দিকে সুদৃষ্টি দিবে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়