অসাম্প্রদায়িক মানবিক বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, শুরু থেকেই তার অবস্থান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ১৯৪৬-৪৭ সালে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং পাকিস্তান সৃষ্টি নিয়ে নানা অসঙ্গতির সৃষ্টি হলো, সেই সময় বঙ্গবন্ধু তার অবস্থা সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেন, ‘ভারতবর্ষে মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষে হিন্দুরাও মুসলমানকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে' (পৃষ্ঠা-৩৬)।
আর, ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন দাগ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকার জো নেই।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আমরা ঠিক যেন কবিগুরুর সেই ব্যক্তিকেই পাই, যাকে অবলম্বন করে একটি বৃহৎ স্বদেশী সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। তিনি যে এক অসাম্প্রদায়িক মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তা এখন আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
বঙ্গবন্ধু সম্প্রীতিকে সবার ওপরে স্থান দিতেন। সারা বিশ্বে ধর্মের নামে হানাহানি আর হিংসার যে উন্মত্ততা, তার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যে কত প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু তার দূরদৃষ্টি দিয়ে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশের সংবিধানে চার মূলনীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে সংবিধানের চার মূলনীতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘...আজ আমাদের নীতি পরিষ্কার। আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে চারটি স্তম্ভ রয়েছে। এটার মধ্যে কোনো কিন্তু-টিন্তু নাই। এটা পরিষ্কারভাবে শাসনতন্ত্রে দেওয়া হয়েছে। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি।...’
ঐ ভাষণেই তিনি বলেছেন, ‘...রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বলি আলামিন-রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান।
সেই জন্যই এক মুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আর এক মুখে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র, প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পূর্ব আরেকটা হচ্ছে পশ্চিম। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায় তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যেও।’
বঙ্গবন্ধু সম্প্রীতিকে সবার ওপরে স্থান দিতেন। সারা বিশ্বে ধর্মের নামে হানাহানি আর হিংসার যে উন্মত্ততা, তার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যে কত প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু তার দূরদৃষ্টি দিয়ে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশের সংবিধানে চার মূলনীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের কর্মীদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছো। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে।’ আমাদের ১৯৭২ সালের পবিত্র সংবিধানে স্বাধীনতার চেতনাসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
আমরা জানি, বাহাত্তরের সংবিধানে উল্লেখ ছিল ‘মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ (অনুচ্ছেদ ১০)
এখানে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চিন্তার প্রাধান্য পাওয়া যায়। এবং ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ১২ (গ)’ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল।
৪১ অনুচ্ছেদে সব ধর্ম পালন ও প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। অনুচ্ছেদ ২৭ এ ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এ দুটি অনুচ্ছেদ অর্থাৎ ২৭ এবং ৪১ মৌলিক অধিকার এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি। এর অর্থ ধর্মহীনতা বা ধর্ম বিমুখতা নয়। এর অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নায়করা নাগরিকদের ধর্ম বা বিশ্বাসের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবেন। কে, কোন ধর্মে বিশ্বাসী বা কে অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক এ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার, সবাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমান-এই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা।
বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বলেন, “আমি বললাম, এর (গণতান্ত্রিক যুবলীগের) কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা করা, যাতে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে- যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা। অনেকেই এই মত সমর্থন করল...।”
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ ওই বছরের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বছর ধর্মের নামে জুয়াচুরি, শোষণ, বেইমানি, খুন, ব্যভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’ বাংলাদেশ সরকার প্রণীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে ধরা হয়, যার মাধ্যমে বিশ্বে দরবারে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো রকম বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের মন বুঝতেন অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার এই জটিল প্রত্যয় সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে জনগণের একটি অংশ বিভ্রান্তির চেষ্টা করতে পারে। সেটা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় বারবার বলেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার আছে। তিনি বাংলার পরাধীন পাকিস্তানের সময়কালে ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে খুন ইত্যাদির কঠোর সমালোচনা করেন।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় তার প্রতিফলন আছে। যেমন সংবিধানে বাংলাদেশ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হওয়ায় প্রাধান্যের ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী (ধারা ২৭) এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না (২৮.১)। রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে (২৮.২)।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিজীবনে ছিলেন ধর্মপ্রাণ, কিন্তু এখনকার মতো লোক দেখানো ধর্মাচরণে তিনি বিশ্বাস করতেন না। ধার্মিক মানুষই অসাম্প্রদায়িক হয়, ধর্মের নামে যারা ভণ্ডামি করে তারাই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ায়।
বঙ্গবন্ধু বলেন, হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান। ...সমাজতন্ত্র, প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পূর্ব আরেকটা হচ্ছে পশ্চিম। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায় তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যেও।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আমরা অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে তার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় পেয়েছি। ১৯৩৮ সালে যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এবং শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এলেন, শেখ মুজিব তখন স্কুলের ছাত্র। তার ওপর ভার পড়েছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার। সে প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কী বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সংবর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। এগজিবিশনে যাতে দোকানপাট না বসে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা ৮০টি দোকান হিন্দুদের ছিল। আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে গান-বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো-সবই চলত।’
বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন, তখন গরিব ছাত্রদের জন্য বেকার হোস্টেলে কতগুলো ফ্রি রুম ছিল। সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশোনা করার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। আমি আর্টসের ছাত্র ছিলাম, তবু নারায়ণ বাবু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি যদিও জানতেন, আমি প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান পাকিস্তান’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলে এই কাজের ভার দিত কেন? কারণ তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতি পরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে।”
বঙ্গবন্ধু যে সব সময়ে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন, একটি নিবন্ধে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন রামেন্দু মজুমদার। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানি শাসকদের মদদে পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। রামেন্দু মজুমদার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, থাকেন তেজগাঁও শিল্প এলাকায় তার বড় ভাইয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে।
দাঙ্গার প্রথম রাতে তাদের বাসার পাশের রেললাইনে ট্রেন থামিয়ে কয়েকজন সংখ্যালঘু যাত্রীকে হত্যা করা হয়। পরদিন সকালে তাদের আত্মীয় অধ্যাপক অজিত গুহ বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে বলেন, ‘তার এক আত্মীয় পরিবার তেজগাঁওতে আতঙ্কের মধ্যে আছে, তিনি যদি তাদের উদ্ধার করতে পারেন।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু তাদের বাসায় এসে উপস্থিত। বললেন, দুই মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে তার সঙ্গে যেতে। তিনি একটা জিপ নিয়ে এসেছিলেন, ড্রাইভারের পাশে তিনি বসলেন, পেছনে সবাই। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন কোথাও না থামিয়ে সোজা তার বাসায় যেতে। ৩২ নম্বরে তার বাড়িতে গিয়ে রামেন্দু মজুমদার দেখলেন শহরের অন্যান্য এলাকা থেকে কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবারকে তিনি এরই মধ্যে এনে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছেন। বেগম মুজিব পরম যত্নে সবার খাবারদাবারের ব্যবস্থা করছেন।
এই যে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা, কয়জন নেতা এ কাজটি করেন? মুখে বলা সহজ, কিন্তু কাজে করে দেখানো কঠিন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যা বিশ্বাস করতেন, জীবনাচরণে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আজ আমাদের দেশে এবং বিশেষত রাজ্যে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা যথেষ্ট উদ্যোগের। বারবার কেন ঘুরে ফিরে আসে এই দুঃসময়। গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে যুযুধান রাজনৈতিক মত প্রতিষ্ঠার তাগিদে তারা ধর্ম নিয়ে যে খেলা শুরু করেছে তারই পরিণতিতে এই পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষকে তার যে কি ফল ভুগতে হয়, আপনাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে!’
১০০ বছর পর অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, সেই অবস্থা থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের একজন নেতা এসেছিলেন। অসামান্য সেই মহামানব বুঝেছিলেন, অসাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদের উন্নয়ন অগ্রগতি সব বাধাগ্রস্ত হবে। বাঙালির মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অশেষ শ্রদ্ধা।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ।। আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ