ফ্যামিলি কার্ড, ন্যায্যমূল্যের দোকানই কি বিকল্প উপায়?
রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না বলে জানিয়েছে আমদানিকারক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। তবে সরবরাহ লাইনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা না হলে, সরকার যদি আমদানিকারক, পাইকারি ও ডিলার পর্যায়ে তদারকি জোরদার করে আমদানিকৃত ও দেশে উৎপাদিত পণ্যগুলো সমভাবে দেশব্যাপী সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত হয় তাহলে কোনো ধরনের সংকটের আশঙ্কা নেই।
ব্যবসায়ীরা চাহিদা ও জোগানের কথা বলে মজুত কম হলেই দাম বাড়িয়ে দেন। আর বাজারে কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। দাম বাড়ালে বা অতি মুনাফা করলে বলার কেউ নেই, সেকারণে একবার আলু, একবার পেঁয়াজ, একবার সয়াবিন তেল ব্যবসায়ীরা সকলেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট কাটছে। আর সরকারের দায়িত্বশীল লোকজন দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন।
আবার গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো শাস্তি বা তিরস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তখন তাদের দেখাদেখি অন্য ব্যবসায়ীরাও মজুতদারি ও সিন্ডিকেটে জড়িত হয়ে যান। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, তারা অপরাধ করলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। সেকারণে পুরো বাংলাদেশটাই যেন দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতার হাট। এখানে সকল প্রকার ব্যবসায়ীরাই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। আর এসমস্ত অপকর্মের হোতারা আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হতে তৎপর থাকেন।
বৈশ্বিক করোনা মহামারির ঢেউ সামলে স্বাভাবিক আয়ে ফিরতে লড়াই করছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাদের এ লড়াই আরও কঠিন করে তুলেছে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাজারে গিয়ে। চাল, ডাল, তেল, আটা থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বাজারের উত্তাপ সইতে না পেরে মধ্যবিত্তরাও টিসিবির ট্রাকের পেছনে দাঁড়াচ্ছেন।
বাজারের উত্তাপ সইতে না পেরে মধ্যবিত্তরাও টিসিবির ট্রাকের পেছনে দাঁড়াচ্ছেন। নিত্যপণ্য পেতে সেখানেও হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অনেকে ফিরছেন খালি হাতে।
নিত্যপণ্য পেতে সেখানেও হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অনেকে ফিরছেন খালি হাতে। এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য মূল্যের অস্থিরতা সামলাতে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। এরই মধ্যে ভোজ্যতেলসহ চিনি ও ছোলার ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিতে আমদানিতে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। নিত্যপণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (ঋণপত্র) মার্জিনের হার ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের কমিটিও করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এছাড়া ব্যবসায়ীদের কারসাজি ঠেকাতে সারাদেশে বাজারে তদারকি জোরদার করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। পণ্য বেচাকেনায় পাকা রসিদের ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। কিন্তু বাজারে নিত্যপণ্যের দামে এসবের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব চোখে পড়ছে না। নিত্যপণ্যের দামে এখনো পুড়ছে প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষ। দীর্ঘ হচ্ছে সাধারণ, সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
রাজধানীতে বাজার দরে মাসের ব্যবধানে প্রয়োজনীয় ১৪টি পণ্যের দাম বেড়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, তেল, আটা, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, গরুর মাংস, কাঁচামরিচ ও ছোলা। চালের বাজার দীর্ঘদিন ধরেই অস্থির।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করা হয়। দেশে এবার আমনের রেকর্ড ফলন ও আউসের ভালো উৎপাদনের পরও মাসের ব্যবধানে বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে ২ টাকা এবং সরু চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মসুর ডালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। এক কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
মাসের ব্যবধানে কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে পেঁয়াজের কেজি হয়েছে ৬৫ টাকা। চীনা রসুনের দামও কেজিতে ১০ টাকা এবং আদা প্রকারভেদে কেজি প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খোলা আটার দামও কেজিতে ২ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি আলুতেও খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ৮ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৬৫ টাকা। গরুর মাংস ঠেকেছে ৬৫০ টাকায়। ডিমের দাম হালিতে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
বাজারে নিত্যপণ্যের দামে এসবের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব চোখে পড়ছে না। নিত্যপণ্যের দামে এখনো পুড়ছে প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষ। দীর্ঘ হচ্ছে সাধারণ, সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেড করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর হিসাবও বলছে, মাসের ব্যবধানে সরু চাল ৩.১৩ শতাংশ, মোটা চাল ৪.৩৫ শতাংশ, বড় দানার মসুর ডাল ২.৫৬ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন তেল ৪.৬৯ থেকে ৬.৫৮ শতাংশ পর্যন্ত, পাম সুপার ১৬.৮৫ শতাংশ হারে দাম বেড়েছে। একই সময়ে খোলা আটা ৮.৭ শতাংশ, চিনি ৩.২৭, দেশি পেঁয়াজ ১০৮, চায়না রসুন ১৪.২৯ এবং আদার ১২.৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
ছোলার দাম এক লাফে সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে। অপরদিকে এক মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম ৬.৯ শতাংশ ও গরুর মাংসের দাম ৫.৮৩ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া কাঁচামরিচ ৭২.৭৩ শতাংশ, আলু ৮.৫৭ শতাংশ দাম বেড়েছে। ফার্মের ডিমের দাম বেড়েছে ২.৭৮ শতাংশ।
ভোক্তা ও বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া, সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার, নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (ঋণপত্র) মার্জিনের হার ন্যূনতম পর্যায়ে রাখাসহ বাজার তদারকি জোরদার করছে। তবুও ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। বাজারে বেশি মুনাফা লুটতে এখনো তৎপর মজুতদার ও সিন্ডিকেট চক্র।
এর আগে পেঁয়াজ ও চাল নিয়ে বাজার অস্থির করে তুলে অল্প সময়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এখন সয়াবিন তেল নিয়ে শুরু হয়েছে। পেঁয়াজ ও চালের উৎপাদন সন্তোষজনক হলেও এগুলোতে বাড়তি মুনাফা করছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। বাজার ব্যবস্থাপনায় গলদসহ অসাধু ব্যবসায়ীদের অপকর্ম বন্ধে সরকারের শিথিলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা সক্রিয় সরবরাহ সংকট ও অতি মুনাফা করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন, যার খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। গোঁড়া থেকে সমস্যার সমাধান না করলে সরকার যতই উদ্যোগ নিক, সুফল মিলবে না।
দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পর্যায়ে ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের বিশাল পার্থক্যই বলে দিচ্ছে আমাদের বাজার ব্যবস্থা ভোক্তাবান্ধব নয়। উৎপাদন অথবা আমদানি পর্যায় এবং ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের বড় ব্যবধান ন্যায্য ব্যবসার পরিচয় বহন করে না।
সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে ১৩ টাকার সবজি রাজধানীর খুচরা বাজারে ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন নজির নেই। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ায়।
বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা আবার পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। যদিও এ ইস্যুতে বিশ্ববাজারে খাদ্য-পণ্যের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তবে এখনই দেশের বাজারে তার প্রভাব সেভাবে পড়ার কথা নয়। কারণ যে সমস্ত পণ্য দেশে মজুত তা দুই থেকে ছয় মাসে আমদানি করা। অথচ তিন মাস আগে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পর্যায়ে ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের বিশাল পার্থক্যই বলে দিচ্ছে আমাদের বাজার ব্যবস্থা ভোক্তাবান্ধব নয়। উৎপাদন অথবা আমদানি পর্যায় এবং ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের বড় ব্যবধান ন্যায্য ব্যবসার পরিচয় বহন করে না।
এদিকে সরকার রমজানে নিত্যপণ্যের মূল্য সংকট লাগবে এক কোটি পরিবারকে রেশন কার্ডের মাধ্যমে দু’বার টিসিবির সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগটি অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে সরকারের এই মহতী উদ্যোগ নির্ভর করছে দু’টি বিষয়ের ওপর। প্রথমত, ফ্যামিলি কার্ড, রেশন কার্ড বিতরণে উপকারভোগী বাছাই প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভাবে, প্রকৃত যোগ্য প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষগুলো যেন তালিকাভুক্ত হন।
দ্বিতীয়ত, পরিবার/রেশন কার্ডধারীদের কাছে টিসিবির পণ্য সহজে প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা। যদি স্থানীয়ভাবে পণ্য কিনতে পাওয়া না যায়, তাহলে পণ্য সংগ্রহে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হলে প্রক্রিয়াটি মানুষের জন্য উপকারী না হয়ে দুর্দশার কারণ হবে। যদিও ভোক্তা ও বাজার বিশেষজ্ঞদের অভিমত ছিল, বিকল্প উপায়ে ভোক্তাদের মাঝে সাশ্রয়ী দামে খাদ্যপণ্য সরবরাহে বিকল্প ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালে রাখতে সরকারি উদ্যোগে মজুদকৃত পণ্য খোলাবাজারে ছাড়তে পারে, সেই সঙ্গে পণ্য পৌঁছানোর আওতা বাড়াতে পারে। টিসিবির ট্রাক সেলে বিপুল পরিমাণ মানুষ সারা দিন অপেক্ষা করে অধিকাংশই বিফল মনোরথে ফিরে যাচ্ছেন।
আবার একই সাথে একজন বারবার পণ্য পাওয়ার অভিযোগও কম নয়। তাই এ অবস্থার সমাধানে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ন্যায্য মূল্যের দোকানই একমাত্র বিকল্প হতে পারে এখাতে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কারণ আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে এ ধরনের ন্যায্যমূল্যের দোকান প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষসহ মধ্য আয়ের মানুষের কাছে ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশেও ন্যায্য মূল্যের দোকানের মডেল বর্তমান নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য থামানো ও দুর্বিষহ দুরবস্থা থেকে জাতিকে রেহাই দিতে পারে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)