শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবি : নৌপথ নিরাপদ হবে কবে?
সুগন্ধার পাড়ে আহাজারি থামতে না থামতেই আবারও শীতলক্ষ্যার তীরে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। ফের নৌ দুর্ঘটনা। ২০ মার্চ কার্গো জাহাজ এমভি রুপসীর ধাক্কায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে মুন্সিগঞ্জগামী এম এল আফসার উদ্দিন লঞ্চটি ডুবে যায়। জাহাজটি লঞ্চটিকে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
শেষ পর্যন্ত এ দুর্ঘটনায় কত মায়ের বুক খালি হবে তা এখনো অজানা। অভিযান-১০ দুর্ঘটনায় এখনো অনেকে নিখোঁজ। সর্বশেষ নৌ দুর্ঘটনায়ও হয়তো কিছু মানুষের নাম আজীবনের জন্য নিখোঁজের তালিকায় থেকে যাবে। পরিবারের লোকদের স্বজনহারা মানুষের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু!
প্রতিটি নৌ দুর্ঘটনার পর নৌপথের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এবারও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আসলেই কী আমাদের দেশের নৌপথ নিরাপদ? মোটেও না। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো নৌপথ। অথচ নদী মাতৃক বাংলাদেশে নৌ নিরাপত্তা গড়ে তোলা সম্ভব হলো না। এরচেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে।
নিরাপদ নৌ যোগাযোগ নিশ্চিত করতে না পারার দায় কারো একার নয়। সরকার, পরিবহন মালিক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সব পক্ষকে কম বেশি এর দায় নিতে হবে। সবচেয়ে বেশি দায় সরকারের, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ নৌপথ নিরাপদ করতে নতুন নতুন পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন সরকারের হাতেই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে নৌপথকে নিরাপদ করা হয়েছে সে ধরনের চিন্তার বাস্তবায়ন যদি কঠোরভাবে করা যেত তাহলে সবাই মানতে বাধ্য হতো, কিন্তু তা হয়নি। তাহলে বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার সড়ক পথের মতোই নৌপথ নিয়ে উদাসীনতা রয়েছে। ভালো করতে না দেওয়ার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। যা মোটেই কাম্য নয়। এই আমলাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।
সারাদেশে কত নৌযান চলাচল করছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। তেমনি ফিটনেসবিহীন নৌযানের সংখ্যা কত এ তথ্যও জানে না নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
পর পর দুটি বড় নৌ দুর্ঘটনার পর দেশে নৌযানের প্রকৃত সংখ্যা কত, নৌযানের ফিটনেস আছে কি না ও দুর্ঘটনার কারিগরি কারণ, নৌ দুর্ঘটনার পর বিচার হওয়া না হওয়ার প্রশ্নটি আবারও সামনে এলো। তেমনি নৌ সেক্টরে প্রয়োজনীয় তদারকি হচ্ছে কি না এ নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ২৩০টি সক্রিয় নদী বহমান আছে ও প্রায় ৪৫০টি নদী দখল ও দূষণের কারণে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র কর্তৃক নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা আছে। নির্দেশনা মতো কি সব কাজ যথাযথ হচ্ছে?
সারাদেশে কত নৌযান চলাচল করছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। তেমনি ফিটনেসবিহীন নৌযানের সংখ্যা কত এ তথ্যও জানে না নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। এসব বিষয় যখন মুখ্য আলোচনায় তখন নৌযানের ফিটনেস, দুর্ঘটনার পর বিচারের প্রত্যাশায় বালি পড়তে পারে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, গেল ৫০ বছরে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ২০ হাজার পথ! দেশের নৌপথ যে অবহেলিত এই পরিসংখ্যান কি যথেষ্ট নয়? যদিও সরকার হারিয়ে যাওয়া নৌপথ উদ্ধারে পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে তা কতদিনে বাস্তবায়ন হয়ে নিরাপদ নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে কেউ জানে না।
তেমনি দেশে কত নৌযান চলাচল করবে, সরকারি দপ্তরে এর কোনো হিসাব থাকবে না, তা কাম্য নয়। এমন বাস্তবতা নৌ পরিবহন সেক্টরে প্রয়োজনীয় তদারকির যথেষ্ট অভাবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নদ-নদীতে সাত লাখের বেশি নৌযান চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ যাত্রীবাহী, বাকিটা পণ্যবাহী। নৌযানের ফিটনেস সনদ, চালকের দক্ষতা, প্রতিটি নৌযানে নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিতসহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবিলায় নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদাহরণ আছে, সেখানে কৃত্রিমভাবে নৌপথ সৃষ্টি করা হয়। অথচ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া সম্পদ চোখের সামনে নষ্ট হচ্ছে। দখল-দূষণ, ভূমিদস্যুদের থাবাসহ ড্রেজিংয়ের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নৌ-রুটগুলো। তিল তিল করে হত্যা করা হচ্ছে নদ-নদীগুলোকে। রাজনৈতিক প্রভাবে নদীর জমি ভূমিদস্যুদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা যাচ্ছে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি নৌপথ হয়তো আরও সংকুচিত হয়ে যেতে পারে- এমন ধারণা অমূলক নয়।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে অনুমোদপ্রাপ্ত নৌযানের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় আট হাজার নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। সরকারি হিসাবের নিবন্ধন করা নৌযানের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার অবৈধ থেকে যায়।
বাংলাদেশের নদ-নদীতে সাত লাখের বেশি নৌযান চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ যাত্রীবাহী, বাকিটা পণ্যবাহী। নৌযানের ফিটনেস সনদ, চালকের দক্ষতা, প্রতিটি নৌযানে নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিতসহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবিলায় নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে।
মাত্র ১৪ হাজার নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না এই যুক্তি কি মেনে নেওয়া যায়। তাহলে কি লোকবল কম, নাকি অন্য কোথাও গলদ? আসলে অনুমোদপ্রাপ্ত নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা যদি প্রতিবছর নিশ্চিত করা সম্ভব না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে নৌপথের বিষয়ে উদাসীনতা আছে। দ্রুতই এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আরও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, গত ৫০ বছরেও দেশে কোনো নৌ-শুমারি হয়নি। ফলে সারাদেশে প্রকৃত নৌযানের সংখ্যা কত? তা জানার সুযোগ নেই। ২০১০ সালে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল বজলুর রহমান নৌ-সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে সারাদেশে ৫০ হাজার নৌযানের কথা উল্লেখ করা হয়। তাহলে অবৈধ নৌযানগুলোকে কেন বন্ধ করা হচ্ছে না? যেখানে বৈধ যানে ত্রুটির শেষ নেই। তাহলে অবৈধ যান কি সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ আছে?
নৌযানের নিবন্ধন ও ফিটনেস দেখতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরে মাত্র ১৮ জন পরিদর্শক! পাশাপাশি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ২৫ জন পরিবহন পরিদর্শকও ফিটনেসসহ নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়গুলো দেখেন! তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে স্বল্প জনবলের এসব পরিদর্শকদের কাজ আসলে কী? তাদের দায়িত্ব কি শুধু রেজিস্ট্রেশন করা নৌযান দেখা? নাকি গোটা নৌ-সেক্টরকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা?
এর বাইরেও নৌযানের সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা-নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর।
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটি-এর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধনহীন জাহাজ থেকে কনজারভেন্সি চার্জ আদায়ের মাধ্যমে তাদের বৈধতা দেন কোনো কর্মকর্তা। নৌ ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। নৌ দুর্ঘটনার সময় নৌযানের ভেতরে থাকা জীবন বাঁচানোর সরঞ্জাম ব্যবহার হয়েছে এমন উদাহরণও কম। আসলে নৌযানের ভেতরে নিরাপত্তা সরঞ্জাম আছে কি না তা কে দেখবে?
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটি-এর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানগুলোর নিবন্ধন নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করতে হয়। এ সনদ দিতে নৌযানের মাস্টার-ড্রাইভারের সনদ, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও অন্য আনুষঙ্গিক বিষয়সহ ৫১টি বিষয় দেখেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়াররা। সেদিক দেখভালের শিথিলতা চরমে। তাই দায়িত্বশীলদের দ্রুত সময়ের মধ্যে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
নিজেদের মতো করে গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরকে যারা পরিচালনা করতে চান তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। সেই সঙ্গে দায়িত্বে অবহেলা করে, ঘুষ নিয়ে আপস করে নৌপথকে অরক্ষিত করে লাভ কাদের হবে? তাদেরও চিহ্নিত করা জরুরি দরকার।
অনিবন্ধিত বালুবাহী (বাল্কহেড) জাহাজ, ট্রলার ও স্পিডবোট মিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার নৌযান চলাচল করে থাকে। আইনগতভাবে নিবন্ধনহীন ১৬ হর্স পাওয়ারের বেশি ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ দাবড়ে বেড়ানো এসব নৌযানকে কোনোভাবেই আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি নৌ পুলিশও কিন্তু মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। তাহলে কীভাবে এসব যান প্রকাশ্যে চলে?
নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানের নকশা নৌ পরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমোদনের পর সেই নকশা অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ করতে হয়। নির্মিত নৌযান পরিদর্শন করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস-সনদ দেয় সার্ভেয়াররা। ওই সনদ দুটি দেখিয়ে বিআইডব্লিটিএ থেকে রুট পারমিট নিতে হয়। এরপরই নৌযান চলাচলের জন্য উপযুক্ত হয়।
বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ শুধু যাত্রীবাহী ৭৮০টি নৌযানের রুট পারমিট দিয়েছে। তবে ফি অনুমোদন না পাওয়ায় পণ্যবাহী নৌযানের রুট পারমিট দেওয়া শুরু করেনি। প্রশ্ন হলো, অন্য নৌযানগুলো কাদের অনুমতি নিয়ে চলাচল করছে? অথচ সারাদেশে ইচ্ছেমতো নৌযান বানিয়ে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করা হয়।
বর্ষা মৌসুমে হাওর-অধ্যুষিত সাত জেলা পুরোপুরি অরক্ষিত থাকে। সেখানে দেখভালের অভাবে দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় যাত্রীদের। নৌ-রুটে সাইন সিগন্যাল সঠিক না থাকারও অভিযোগ বিস্তর। যারা কাজ করে না তাদের তো সিগন্যাল ঠিকঠাক রাখার প্রয়োজন নেই! নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোই হয়তো জরুরি। দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ সঠিকভাবে পরিচালনা মানেই পুরো সেক্টর ভালোভাবে চলছে এমন মানদণ্ড নির্ভর করে না।
সব আলোচনার সার সংক্ষেপ হলো তাহলে কি নৌপথ অরক্ষিত হয়েই থাকবে? সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই নৌপথকে নিরাপদ করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাবো। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার অন্তরালে গজিয়ে থাকা সংকট চিহ্নিত করতে হবে। সেইসঙ্গে সবকিছুতেই স্বচ্ছতা জরুরি। তেমনি দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। আনতে হবে জবাবদিহির আওতায়।
সঠিক পদক্ষেপে নিরাপদ নৌপথ গড়ে তোলা সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে, তেমনি নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও সুদৃঢ় হবে। চলমান অবহেলায় দেশের নৌপথ হারিয়ে যাক এটা কারো কাম্য হতে পারে না।
রাজন ভট্টাচার্য ।। সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]