বঙ্গবন্ধু ও ‘সোনার বাংলা’ রূপকল্প
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্যবার ব্যবহার করেছেন ‘সোনার বাংলা’ শব্দবন্ধটি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। তার স্বপ্নের রূপকল্প ‘সোনার বাংলা’ কেবল আবেগী কাব্য ছিল না বরং ছিল মানবিক উন্নয়নের এক বাস্তবায়নযোগ্য পরিকাঠামো।
সোনার বাংলা রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার প্রথম তিনবছরে বঙ্গবন্ধু জোর দিয়েছেন পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রমের ওপর। যুদ্ধবিধ্বস্ত শূন্য রিজার্ভের সাত কোটি মানুষের নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ ছিল তার জন্য অভূতপূর্ব এক চ্যালেঞ্জ, যে চ্যালেঞ্জ আর কাউকে মোকাবিলা করতে হয়নি।
অতি স্বল্প সময়ে জাতিসংঘসহ ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য লাভ, ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি লাভ, পাকিস্তানে আটকে পড়া চার লাখ বাঙালি ফিরিয়ে আনার মতো কূটনৈতিক সাফল্য যেমন বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছেন তেমনি অসামান্য ছিল পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন উদ্যোগ।
বঙ্গবন্ধু বারবার সকলের সম্মিলিত সহযোগিতার আহ্বান জানালেও আত্মগোপনকারী স্বাধীনতা বিরোধী ও অতিবাম গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করে। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে তারা পাটের গুদাম, সারের কারখানা ধ্বংস করে, রেল লাইন উপড়ে ফেলে। এছাড়া ছয়জন নির্বাচিত সংসদ সদস্যসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা কর্মী হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
তবু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা দমাতে পারেনি। এ সময় অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি মুখ্যত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয় তার মধ্যে টেস্ট রিলিফ, পূর্ত কর্মসূচি ও গৃহনির্মাণ প্রকল্প অন্যতম।
সোনার বাংলা রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার প্রথম তিনবছরে বঙ্গবন্ধু জোর দিয়েছেন পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রমের ওপর। যুদ্ধবিধ্বস্ত শূন্য রিজার্ভের সাত কোটি মানুষের নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ ছিল তার জন্য অভূতপূর্ব এক চ্যালেঞ্জ, যে চ্যালেঞ্জ আর কাউকে মোকাবিলা করতে হয়নি।
টেস্ট রিলিফের মাধ্যমে ২ কোটি ৩০ লাখ লোক এবং ২৫.৭৫ লাখ একর জমিতে কৃষি উৎপাদন উপকৃত হয়। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত দেশবাসীর জন্য ১ কোটি ৪১ লাখ ৮১ হাজার ৮৮৫ মণ খাদ্য শস্য ছাড়াও বিপুল পরিমাণ গুঁড়া দুধ, শিশু খাদ্য, তাঁবু, ত্রিপল ও শাড়ি বিনামূল্যে বিতরণ করে।
একইভাবে জাতীয় পুনর্বাসন বোর্ড পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত হাজার হাজার নারীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। এ জন্য চারটি বৃত্তিমূলক ট্রেনিং কেন্দ্র এবং সাতটি সেলাই ও হস্তশিল্প শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়।
এছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের রিলিফ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কেন্দ্রীয় মহিলা সংস্থার মতো স্বেচ্ছাসেবামুলক প্রতিষ্ঠান সমূহকে মাসিক মঞ্জরি বরাদ্দ করে। সহায় সম্বলহীন মহিলা ও শিশুদের পরিচর্যা এবং নিরাপত্তার জন্য মহকুমা পর্যায়ে ৬২টি কেন্দ্র ও স্থাপন করা হয়।
মাত্র এক বছরের মধ্যে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩ মাইল মিটারগেজ ও ১৬ মাইল ব্রডগেজ রেলপথের মধ্যে ৪৩ মাইল মিটারগেজ ও ১৬ মাইল ব্রডগেজ ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। ২৯৫টি রেলব্রিজের মধ্যে ৮২টি স্থায়ীভাবে এবং ১৯৮টি অস্থায়ীভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
স্বল্পতম সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুনরায় চালু করা হয়। ২৭৪টি বিধ্বস্ত সড়ক সেতুর মধ্যে ৫৫টি স্থায়ী মেরামত এবং ৯৬টি সাময়িক ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুরোধে সোভিয়েত নৌবাহিনী এসে মাইন অপসারণ করে সমুদ্র বন্দর ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।
প্রথম তিন বছরে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দেন টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি ও মানবিক উন্নয়নে। এই নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি হচ্ছে বাকশাল, বঙ্গবন্ধুকে যাকে আখ্যায়িত করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব বলে।
মনে করা যেতে পারে—১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর লেনিন একই ভাবে প্রথম পাঁচ বছর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে ১৯২১ সালে চালু করেছিলেন ‘নিউ ইকোনমি পলিসি’। বাকশাল কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছিলো চারটি- ১। দুর্নীতি উচ্ছেদ, ২। উৎপাদন বৃদ্ধি, ৩। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও ৪। জাতীয় ঐক্য।
অসাধারণ প্রজ্ঞাবান বঙ্গবন্ধু জোর দিয়েছিলেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর। অধিক জনসংখ্যার এই রাষ্ট্রে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে, সেজন্য বাকশালের অন্যতম কর্মসূচি ছিল এটি।
মানবিক উন্নয়নের রূপকার হিসেবে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা ছাড়া সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না। তাই বাকশাল কর্মসূচিতে তিনি প্রতি গ্রামে সমবায় গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের মতো মালিকানা কেড়ে নিয়ে নয় বরং কৃষকদের মালিকানা বহাল রেখে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় সম্মিলিত সমবায় কার্যক্রম।
দুই যুগ ধরে মানুষের অধিকারের পক্ষে সংগ্রাম করে তিনি জেনেছিলেন, উপনিবেশ মডেলের আমলাতন্ত্র ও পুরনো সরকার পদ্ধতিতে এটি সম্ভব নয়। তাই তিনি খোলনলচে পাল্টে ফেলতে চেয়েছিলেন পুরনো ধারার। আমলাতন্ত্র জবাবদিহিতা করবে জনগণের প্রতিনিধি রাজনীতিবিদদের কাছে। আমলা, রাজনীতিবিদ সমন্বয়ে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। কৃষককে হয়রানির শিকার হতে হবে না, বরং কৃষকের কাছে পৌঁছে যাবে সার বীজ সেচের উপকরণ।
প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে বাকশাল কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেকটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলের ইউনিয়ন পরিষদগুলো হয়ে উঠেছিল স্থানীয় ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্র, সেগুলো ভেঙে দিয়ে গ্রামভিত্তিক সরকার তার পরিকল্পনায় ছিল, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ইউনিট পৌঁছে যাবে গ্রাম পর্যন্ত।
অসাধারণ প্রজ্ঞাবান বঙ্গবন্ধু জোর দিয়েছিলেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর। অধিক জনসংখ্যার এই রাষ্ট্রে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে, সেজন্য বাকশালের অন্যতম কর্মসূচি ছিল এটি।
অন্নুনত রাষ্ট্রগুলোর পিছিয়ের পড়ার বড় কারণ নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবোধ,সংঘাত, অনৈক্য। একটা সুখী সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য ক্ষুদ্রতা পরিহার করে জাতীয় ঐক্য জোরদার করার উপর জোর দিয়েছিলেন জাতির জনক।
কেবল নিষ্প্রাণ অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, সপ্রাণ মানবিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বারবার তাগিদ দিয়েছেন- সোনার বাংলা গড়তে হলে ‘সোনার মানুষ’ চাই।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের উন্নয়নের গতিধারা ব্যাহত করা হয়েছিল, পরিত্যক্ত করা হয়েছিল মানবিক রূপকল্প বাকশাল। তবু ত্রিশ লাখ শহীদদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ মানেই আশায় ঘর বসতি।
মারি ও মড়ক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামরিক শাসন ও ধর্মীয় মৌলবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান। কিন্তু স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ নিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘সোনার মানুষ’ গড়ে তোলার জন্য যে জোর দিয়েছিলেন সেটি বিস্মৃতি হওয়া যাবে না।
সকল উন্নয়ন হতে হবে মানুষকে মৌলিকত্ব ও মানবিক মর্যাদার সপক্ষে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ রূপকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
হাসান মোরশেদ ।। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ’ বইয়ের লেখক।