বঙ্গবন্ধু : দরিদ্রজনের সখা
বঙ্গবন্ধু আজীবন দরিদ্রজনের সখা ছিলেন। তাদের কষ্টে তিনিও কষ্ট পেতেন। মানুষের প্রতি যে অক্ষয় ভালোবাসা তার জীবনের অস্তিত্বের প্রতীক ছিল সেটিই তাকে করেছে মহান। ছোটবেলা থেকেই তিনি অভুক্তের জন্য খাবারের ব্যবস্থা, গরিব ছাত্রদের জন্য মুষ্টি চাল সংগ্রহ করা, দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের জন্য লঙ্গরখানা স্থাপন করা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপর্যস্তদের জন্য ত্রাণশিবির খোলার মতো মানবিক কাজে তার উৎসাহের কোনো শেষ ছিল না।
তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই আশায় যে একটি স্বাধীন দেশে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হবে, কৃষক সন্তানেরা পেট ভরে ভাত খাবে, তাদের শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ মিলবে এবং তারা মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু যে কায়দায় পাকিস্তান নামের এক অমানবিক এবং অবাস্তব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো তাতে তিনি এবং তার সহযোগীরা দারুণ আশাহত হলেন। তাই অনেকটা ভগ্ন হৃদয়েই কলকাতা থেকে ঢাকায় এলেন। সূচনা করলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাংলা ভাষার মর্যাদাহানির অপতৎপরতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করার তীব্র বাসনা দেখে তিনি উৎফুল্ল হলেন। তমদ্দুন মজলিশের সাথে মিলে ছাত্রলীগকে নিয়ে শুরু করলেন ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তিনি এবং সহযোদ্ধাদের অনেকেই গ্রেফতার হলেন। শুরু হলো তার বারেবারে জেলে যাওয়ার এক অবিস্মরণীয় অভিযাত্রা।
একেবারে তরুণ বয়সেই তিনি পূর্ব বাংলায় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিকল্প একটি গণতান্ত্রিক উদারনৈতিক দল গড়ার কাজে সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা করেছেন। প্রতিটি সভাতেই ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের জোর দাবি করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দিতে গিয়ে উপাচার্যের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন। মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেতে অনাগ্রহী ছিলেন বলে দীর্ঘদিন জেলেই থাকতে হয়। জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। তাকে করা হয় যুগ্ম সম্পাদক। এরই মধ্যে জোরদার হতে থাকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন।
বাহাত্তরেই তিনি কৃষকদের ওপর থেকে দশ লক্ষ সার্টিফিকেট মামলা তুলে নিলেন, পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা না দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন, খাস জমি ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করলেন।
জেলখানায় বসেই তিনি সেই আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক রাখেন। এক পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাতে গোপনে ছাত্রনেতারা তার সাথে গোপন বৈঠক করেন। তাদের তিনি আন্দোলনের রূপরেখা দেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেন তাদের সাথে মিলে। নিজে আমরণ অনশনে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। জেল কর্তৃপক্ষ টের পেয়ে তাকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেন। সেখানেও তিনি অনশনে যান। তারপরের কথা সবাই জানি। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি হলো। ছাত্ররা শহীদ হলো। বঙ্গবন্ধু তখন অনশনে।
ফেব্রুয়ারির শেষদিকে মুক্তি পান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দলকে চাঙ্গা করতে শুরু করেন। ভুখা মিছিল থেকে শুরু করে সারাদেশে খাদ্য সংকট নিয়ে কথা বলেন। ভাষা আন্দোলনকে তিনি শুধু ভাষার দাবির আন্দোলন মনে করতেন না। এর পেছনে এদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির প্রশ্নটিও জড়িত সে কথাটি বলতে কখনো ভুলতেন না।
১৯৫২ সালে তিনি চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বিভিন্ন কৃষি খামার, শিল্প কারখানা, শ্রমিক কলোনি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। এত অল্প সময়ে চীন কেমন করে ভূমিসংস্কার সম্পন্ন করল এবং সকলের ভাগ্যোন্নয়নে রাষ্ট্র নিবেদিত হলো সেসব কথা জানার চেষ্টা করেছেন। উদ্দেশ্য যদি কখনো দেশ পরিচালনার সময় পান তাহলে সেসব সংস্কারে তিনি ব্রতী হবেন।
পাকিস্তান আমলেও তিনি দু’বার স্বল্প সময়ের জন্য প্রাদেশিক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তখনো তিনি সমবায়, ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে নানামুখী নীতি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। আর তার ছয় দফা আন্দোলনের মূলেই ছিল বৈষম্য দূর করে এদেশে এমন একটি অর্থনীতি চালু করা যেখানে গরিবসহ সকল মানুষের ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ থাকে। তাই তো ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগ দিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণটি তিনি দিয়েছিলেন তাতে কৃষকের পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ এবং জমির মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা বেধে দেওয়ার অঙ্গিকার ছিল। ছিল কৃষির আধুনিকায়ন এবং উৎপাদনশীল সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। সেই সব প্রতিশ্রুতি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে যথেষ্ট সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন তার পরিকল্পিত উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে।
তিনি কৃষির ওপর জোর দিতেন, কারণ তিনি জানতেন এর ফলে গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়বে। তাতে দারিদ্র্য কমবে। আর খাদ্য সংকট তো মিটবেই। সাথে সাথে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে।
সেই অর্থে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল তার সুদূরপ্রসারী গরিবহিতৈষী উন্নয়নের রূপরেখা। ঐ পরিকল্পনায় যে বিনিয়োগ বরাদ্দ ছিল তার ২৪ শতাংশই ছিল কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য। এরপর ছিল শিল্পোন্নয়ন বাবদ। তারপরের বরাদ্দ ছিল মানুষের ওপর বিনিয়োগের জন্য। অর্থাৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার জন্য।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে সমাজের ভেতরে রয়েছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। সেটিই আমাদের জন্য হতে পারে সবচেয়ে বড় পুঁজি। তাই তো তার আহ্বান ছিল, ‘মোবিলাইজ দ্যা পিপল।’ তাদের সমবায়ের অধীনে সমাবেশ করার পক্ষে ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি সবুজ বিপ্লবেও বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বাহাত্তরেই তিনি কৃষকদের ওপর থেকে দশ লক্ষ সার্টিফিকেট মামলা তুলে নিলেন, পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা না দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন, খাস জমি ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করলেন। একই সঙ্গে ঐ বছরই সতেরো হাজার মেট্রিক টন উন্নত বীজ আমদানি করে কৃষকদের মাঝে বিতরণের উদ্যোগ নিলেন।
তার শাসনামলে চল্লিশ হাজার লো-লিফ্ট পাম্প, ২,৯০০ গভীর নলকূপ এবং তিন হাজার অগভীর নলকূপ বিতরণ করার উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব বাঁধ ও সেচ প্রকল্প ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো পুনর্নির্মাণের উদ্যোগও তিনি গ্রহণ করেন।
পাশাপাশি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন কৃষকদের কাছে কৃষিঋণ বিতরণের জন্য। তিনি কৃষির ওপর জোর দিতেন, কারণ তিনি জানতেন এর ফলে গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়বে। তাতে দারিদ্র্য কমবে। আর খাদ্য সংকট তো মিটবেই। সাথে সাথে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে। সে কারণে শিল্প ও বাণিজ্যিক পণ্যের চাহিদাও বাড়বে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা তার মজ্জাগত ছিল। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের ঊষালগ্নে ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি কী চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক? আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।’
তিনি শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং ধনীদের আরও ধনী হওয়ার লাগাম টেনে ধরার অঙ্গীকারের কথা বলেছিলেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রামে যেতে বলেছেন। গ্রামের মানুষের দুঃখ নিজ চোখে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
এই স্বপ্ন তিনি কীভাবে পূরণ করতে চেয়েছিলেন? একই বছর সাতই জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং ধনীদের আরও ধনী হওয়ার লাগাম টেনে ধরার অঙ্গীকারের কথা বলেছিলেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রামে যেতে বলেছেন। গ্রামের মানুষের দুঃখ নিজ চোখে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
এই বাংলাতেই তিনি সাদাসিধে জীবনযাপন করে গেছেন। সকলের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবলেও নিজের জীবনকেই তিনি অরক্ষিত রেখেছিলেন। আত্মঘাতী বাঙালির কতিপয় বিশ্বাসঘাতক কুসন্তান কাপুরুষের মতো রাতের অন্ধকারে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা করে। তার রক্তে ভেসে যায় সারাবাংলা। কিন্তু সেই রক্তে ঠিকই উর্বর হয়েছে বাংলার মাটি। সবুজ হয়েছে বাংলার প্রকৃতি। তাই তো ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল নাগাদ মাথাপিছু আবাদি জমি ২৮ ডেসিমেল থেকে কমে ১০ ডেসিমেলে নেমে এলেও মাথাপিছু চাল উৎপাদন বেড়েছে ১৪০ কেজি থেকে ২৪০ কেজিতে।
কৃষির অসামান্য অগ্রগতির ভিত্তি বঙ্গবন্ধু গড়ে দিয়ে গেছেন। অসংখ্য কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, কৃষি স্নাতকদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, কৃষির জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এবং শিক্ষাকে মাঠধর্মী করার মতো কত ইতিবাচক উদ্যোগই না তার স্বল্পকালীন দেশ পরিচালনার সময় নিয়েছিলেন।
মাঝখানে দেশটা চলছিল ‘অদ্ভুত উটের পিঠে’ মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত চেতনায়। অনেক ত্যাগ ও সংগ্রাম শেষে স্বদেশ ফের ফিরেছে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে তারই কন্যার হাত ধরে। বঙ্গবন্ধু কন্যার উন্নয়ন কৌশলও অন্তর্ভুক্তিমূলক। তিনিও কৃষিতে সর্বোচ্চ সরকারি বিনিয়োগের পক্ষে। কেননা তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতোই বিশ্বাস করেন যে কৃষির প্রবৃদ্ধি ও দক্ষতাই আমাদের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিরসনের পরীক্ষিত কৌশল। সে কারণেই গত বারো-তেরো বছরে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ২৫ শতাংশ উন্নতি হয়েছে এবং পুষ্টি মানের উন্নয়নেও কৃষি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
করোনা সংকটকালে কৃষিই আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিয়েছে। সরকারও সেজন্যে কৃষির পেছনে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে কার্পণ্য করেনি। হালের রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব আমদানি করা গম ও ভোজ্যতেলের ওপর পড়ছে। এখান থেকেও শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো দেশেই সয়াবিন, সরষের তেল ও গম উৎপাদনে আরও বেশি করে প্রণোদনা ও কৃষি সম্প্রসারণে নীতি মনোযোগ বাড়াতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তার কৃষিবান্ধব দারিদ্র্য নিরসনধর্মী কথাগুলো বেশি বেশি মনে পড়ছে বলেই আজ তার এই দিকটির ওপর সামান্য আলো ফেললাম। তার এসব ভাবনাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো সামাজিক পুঁজি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই প্রান্তজনের সখাকে নিরন্তর পরিচয় করিয়ে দেওয়া আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। স্বতোৎসারিত হোক এই নাম চিরদিন।
অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর