আশামনির আত্মহত্যা : আমাদের দায় এড়ানোর সুযোগ কোথায়?
আত্মহত্যা করলো ধর্ষণের শিকার কিশোরী। ঘটনা জামালপুরের মেলান্দহে। নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেওয়ার আগে মা-বাবাকে চিঠি লিখে গেছে মেয়েটি। দু’টি চিঠির একটিতে লিখেছে- ‘মা, আমার সঙ্গে ওয়াহার চেয়ারম্যানের ভাতিজা আজ এক রুমে কাটাইছে। ও আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো। ও আমারে বলছে, ওর সঙ্গে দেখা করলে সে আমার জীবন থেকে চলে যাবে। কিন্তু ও আমার সঙ্গে খুব খারাপ কিছু করছে, যা বলার মতো না। বাবা-মা তোমরা ভালো থেকো। আর ছেলেটির নাম তামিম। ইতি তোমাদের আদরের আশামনি।’
অন্যটিতে লিখেছে- ‘মা, পারলে ক্ষমা করো। যদি কোনো বিচার করো, ছেলেটার নাম তামিম। মা-বাবা তোমরা ভালো থেকো। আমাকে ভুলে যেও। আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের সম্মান শেষ হয়ে যেতো। বাবা-মা আবার বলছি ভালো থেকো। গুড বাই, সোনা বাবা মা।’
জামালপুরের ‘ধর্ষণের শিকার’ এই কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনায় আসামি তামিম আহম্মেদ স্বপনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আপাতত এটুকু সান্ত্বনা। কিন্তু কিশোরীর পরিবার যা হারিয়েছে সেটা কোনো গ্রেফতার বা বিচারেই পূরণ হওয়ার নয়।
মেয়েটি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ধর্ষণের শিকার এই কিশোরী যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হলো বা নারীরা হয় তার উৎস কোথায়? অবশ্যই সমাজ এবং সমাজের সেইসব প্রতিষ্ঠান, যাদের দায়িত্ব এ ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে ধর্ষিতাকে নিক্ষেপ না করে তাকে পুনর্বাসিত করা।
এরকম ঘটনা প্রথম নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি ধর্ষণের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে অনেক নারী। একের পর এক এই ধরনের ঘটনায় আমরা চিন্তিত। একটা দেশে মেয়েদের ক্রমাগত নারী নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে...
পুলিশ প্রশাসন এমনই এক প্রতিষ্ঠান, যার কাছে নির্যাতিতা নারী সর্বাগ্রে প্রতিকার আশা করে। সেই প্রত্যাশা থেকে থানায় অভিযোগ জানাতে যায়। কিন্তু এখানে যে আরও যন্ত্রণা। বারবার থানায় হাজিরা দেওয়া, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করাতে উপর্যুপরি পীড়াপীড়ি, পুলিশের হাজার প্রশ্নের (যেগুলোর সবকটি খুব কমই শালীন প্রশ্ন) জবাব দিতে-দিতে ক্লান্ত নারীরা নতুন করে প্রকাশ্যে নিপীড়িত হতে থাকে।
তাদের সাথে সমাজ ও তার প্রতিষ্ঠান সমূহ এমন আচরণ করে, যা ধর্ষণের যন্ত্রণা, গ্লানি ও অবসাদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আত্মহত্যায় প্ররোচনা তাই কেবল নির্দিষ্টভাবে ধর্ষকদের কাছ থেকেই আসে, এমন নয়। সমগ্র সমাজই এই আত্মবিনাশে প্ররোচনা দেয়। এই কিশোরীর বেলায়ও সেটাই হয়েছে। সে সমাজকে, আশেপাশের মানুষকে আর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভয় পেয়ে নিজেকেই পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়েছে।
ধর্ষণের শিকার কিশোরী বা নারীর ‘পোশাক-আশাক’, ‘স্বভাব-চরিত্র’, একাকী ‘অসময়ে’ পথে নামার দুঃসাহস নিয়ে কটাক্ষ করে এই সমাজ কার্যত ধর্ষকদের অপরাধ লঘু করে দেয়। তেমন এক অবস্থায় নারীর মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে ক্রমাগত।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখি পুলিশ ধর্ষণকারী দুর্বৃত্তের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর ‘আগে থেকেই সম্পর্ক থাকা’র অজুহাত দেয়। এতে করেও দুষ্কৃতি-দমন অপেক্ষা তার ভুক্তভোগীদের দোষ ধরার কদর্য চেষ্টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, সম্প্রতি কক্সবাজারে ধর্ষণের এক ঘটনায় আমরা এমনটা দেখেছি।
সর্বসমক্ষে, উৎসুক প্রতিবেশীদের ভিড়ে, অভিভাবকদের প্রশ্নবাণে, পুলিশের উপর্যুপরি জেরায় এবং আদালতে উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদ ও সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়ায় অবিরাম সেই ধর্ষণের যন্ত্রণা ও গ্লানি ফিরে ফিরে আসে। মনের ক্ষত নিরাময়ের মতো কোনো করুণাধারা সমাজ বর্ষণ করে না, সেই ক্ষতস্থান থেকে নিয়ত রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
পুলিশ, আদালত, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা, এমনকি গণমাধ্যমও সেটা ভুলতে দেয় না। বরং সেই নারীর পুনর্বাসনের পথ রুদ্ধ করে প্রত্যেকেই নিজের মতো, নিজের ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ধর্ষণ-কাণ্ডের কাটা-ছেঁড়া করতে থাকে।
এই লড়াইয়ে জেতা কঠিন জেনেই জামালপুরের কিশোরী আশামনি আত্মহত্যা করেছে। যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার তো এই বয়সে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখার কথা। অথচ সেই বয়সে ধর্ষকে রূপান্তরিত হলো সে। এর পেছনে রয়েছে অবশ্যই শিক্ষার অভাব।
এরকম ঘটনা প্রথম নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি ধর্ষণের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে অনেক নারী। একের পর এক এই ধরনের ঘটনায় আমরা চিন্তিত। একটা দেশে মেয়েদের ক্রমাগত নারী নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে, তাদের প্রাণে মেরে ফেলা হচ্ছে বা আত্মহননে বাধ্য করা হচ্ছে। এর শেষ কোথায় সেটাই এখন সবার জানতে চাওয়া।
একের পর এক নারকীয় নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসছে বারবার। প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা। প্রশ্ন উঠছে, কেন আরও কঠোর করা হচ্ছে না ধর্ষকদের শাস্তি? কেন ধর্ষণের শাস্তির বিচার প্রক্রিয়ার এত শ্লথ গতি? বিকৃতকামী মানসিকতা এমন পর্যায়ে গেছে যে প্রতিবন্ধী, এমনকি, মানসিক ভাসমান্যহীন নারীরাও নিগ্রহের স্বীকার হচ্ছেন।
সমস্যা অনেক গভীরে। শুধু গ্রেফতার আর আটকে সমাধান নেই। পরিবর্তন দরকার সামাজিক ভাবনায়, মনোজগতে। আমাদের সমাজ ধর্ষককে সাদরে গ্রহণ করলেও ধর্ষণের শিকার নারীকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে না, সন্মান তো দূরের কথা। প্রতিপদে লড়াই সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় তাদের।
এই লড়াইয়ে জেতা কঠিন জেনেই জামালপুরের কিশোরী আশামনি আত্মহত্যা করেছে। যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার তো এই বয়সে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখার কথা। অথচ সেই বয়সে ধর্ষকে রূপান্তরিত হলো সে। এর পেছনে রয়েছে অবশ্যই শিক্ষার অভাব। পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, পারিবারিক মূল্যবোধ শিক্ষার অভাবে নাবালকদের মধ্যেও প্রবেশ করছে বিকৃতকামী মানসিকতা।
আট থেকে আশি, যেকোনো বয়সী নারীর ক্ষেত্রে বারবার আঘাত নেমে আসায় নারী নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে। কিন্তু একইসাথে সমাজের এই ধর্ষণপন্থী অবস্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন। ধর্ষণের চেয়েও বড় অপরাধ, পুরুষতন্ত্রের ক্ষুদ্রতা। নিদ্রিত বিবেক জাগাবার সময় এখন।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, গ্লোবাল টেলিভিশন