টিসিবির লাইনে মানুষ বাড়ছে কেন?
ফুটপাত ধরে হাঁটার সময় দেখি অনেকেই ওজন মাপেন। স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে যেমন মাপেন, তেমনি শখেও মাপেন। আমারও ইচ্ছা হয় মেপে দেখি, ওজন কম বেশি নিয়ে আগ্রহ নেই। দেহের মাপ বয়ে বেড়ানোর সময় বুঝতে পারি, কত ওজন নিয়ে চলছি। তবে গত কয়েকদিন ইচ্ছা করছে মাপ যন্ত্রটাতে ওঠার। উঠে দেখতে চাই আমার শ্রেণিগত উন্নতি কতটা হলো?
মধ্যবিত্তে ছিলাম বলে জানি। সাদামাটা মধ্যবিত্ত। সেখান থেকে উড়ালপুলের সঙ্গে আমারও উচ্চ মধ্যবিত্তে আসন হলো কি না, মেপে দেখার ইচ্ছা জাগে। ইচ্ছাপূরণে দেরি করতে নেই। তাই সামনে যে ওজন যন্ত্র পেলাম, তাতেই দাঁড়িয়ে গেলাম। ওমা, আমি যে শ্রেণিচ্যুত হওয়ার পথে! মধ্যবিত্ত থেকেও খসে পড়তে যাচ্ছি।
খসে যে পড়ছি, প্রমাণ মিলল বাজারে গিয়ে। কতকিছু সাজানো গোছানো। হেলাফেলায় থাকা টমেটো, পটল, করলা, পেঁয়াজ প্রায় শোপিসের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। তেল এখন মুদির বদলে জুয়েলারির দোকানে উঠে যাওয়ার পথে। শিকল তালা চাবি দিয়ে ‘তেল’এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
অপেক্ষায় আছি কখন মুরগি, ছাগল, গরুর মাংসের নিরাপত্তার জন্য শিকল, সিন্দুকের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের নিরাপত্তা কত জোরদার করা হবে, সেটা বিক্রেতা বা বাজার তদারকদের ব্যাপার। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি এই নিত্যপণ্যগুলো ক্রমশ আমার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
শুধু কি ভোগ্যপণ্য? কোন পণ্যে লাগেনি তেল-চর্বি? তেলের দামের অজুহাত তুলে পটল থেকে রড, সিমেন্ট সবকিছুর দামই বেড়েছে।
সেদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় চমকে উঠি দীর্ঘলাইন দেখে। দূর থেকে শুধু নারী-পুরুষের লম্বা লাইন দেখতে পেরেছিলাম। আবাসিক এলাকায় এমন লাইন শুধু দেখা যায় জাকাত দেওয়ার সময়। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে দেখি ট্রাক ঘিরে আছে শত শত মানুষ।
ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাক সাধারণত অফিস পাড়া বা বাজারে দেখা যায়। সেই ট্রাক ঘিরে থাকা মানুষদের শ্রেণি আমাদের জানা। কিন্তু ঐ রাতে স্পষ্টত বুঝতে পেরেছি, আশপাশের কলোনি, ফ্ল্যাটের মানুষেরাও এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। বাঁধা আয়, বেতনের মানুষেরা বাজারের বাড়তি দামে পণ্য কেনার সামর্থ্য হারিয়ে এখন ট্রাকের পেছন পেছন ছুটছেন।
শুধু কি ভোগ্যপণ্য? কোন পণ্যে লাগেনি তেল-চর্বি? তেলের দামের অজুহাত তুলে পটল থেকে রড, সিমেন্ট সবকিছুর দামই বেড়েছে। তেলের দাম বাড়ার পেছনের অজুহাত ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ। তার প্রভাবে জ্বালানি তেলের দামসহ আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম কতটুকু বেড়েছে এবং দেশে কতটুকু বাড়ানো হলো, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।
সাধারণত সেই কাজটি কখনোই করা হয় না এবারও হচ্ছে না। দেখা উচিত আন্তর্জাতিক বাজারে কোন কোন পণ্যের দাম বেড়েছে, বাংলাদেশে বাড়ানো হলো কোন কোন পণ্যের দাম। তেল- গ্যাসের প্রভাবে ভোগ্যপণ্য নয়, এমন পণ্যের দাম বাড়া কতটা যৌক্তিক।
রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখলে, বলা হয়, জাতীয় সঞ্চয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে অনেকটা। কিন্তু এখানে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সম্পদ ‘কতিপয়’-এর দখলে থাকায় বৈষম্য এবং আয়ের তারতম্য রয়েছে।
করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। তছনছ করেছে দেশের অর্থনীতিকেও। গোড়া থেকেই বলা হচ্ছিল, করোনার কারণে বিশ্বে উৎপাদন কম হবে। উৎপাদন কম হলে বাজারে পণ্য ঘাটতি দেখা দেয়া স্বাভাবিক এবং বাজারের সূত্রমতে তার দামও বাড়বে। মুশকিল হলো করোনার সময় কাজ হারিয়ে এবং আয় কমে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
স্থানীয় বাজারে শুধু নয়, বিশ্ববাজারেও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এখন এই যে বাজারের বর্তমান চিত্র, তার পূর্বাভাস আগেই পাওয়া যাচ্ছিল বাজারে একটা হুলুস্থুল পরিস্থিতি তৈরি হবে। সেটা তো আগের নানা দুর্যোগ থেকেই জানা। তাই পণ্য আমদানি, পণ্য সরবরাহ বা বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগাম ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল। ভোগ্যপণ্যের বাজার যখন উচাটন, তখন অন্যান্য সেবা মূল্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবুর করা যেত কি না সেটিও বিবেচ্য।
ট্রাকের পেছনে ছুটে চলা মানুষগুলোর সামনে কিন্তু উন্নয়নের ঝলক আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই গত দেড় দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। এখনো উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অনেকটাই নির্মাণ পর্বে আছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে সেবার মান বাড়বে। জীবন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসবে।
রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখলে, বলা হয়, জাতীয় সঞ্চয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে অনেকটা। কিন্তু এখানে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সম্পদ ‘কতিপয়’-এর দখলে থাকায় বৈষম্য এবং আয়ের তারতম্য রয়েছে।
কতিপয়ের সম্পত্তির সঙ্গে জনগোষ্ঠীকে ভাগ করে দেওয়ায় মাথাপিছু এই আয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু গড় মানুষের আয় কিন্তু তলানিতে। বাড়ছে নতুন গরিবের সংখ্যা। মধ্যবিত্তের অবনমন ঘটছে। এই বাস্তবতায় গড় মানুষ যখন তার পরিবারের জন্য এক লিটারের তেলের বোতল কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে, তখন তার নজরে উন্নয়নের তিল কখনোই উপভোগ্য হবে না। সুতরাং অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যক্তির উদরের সুখও নিশ্চিত করা জরুরি। কল্যাণ রাষ্ট্র নিশ্চয়ই এই বিষয়ে দরদি হবে।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী