নারী এগিয়ে আসছে কিন্তু নিরাপত্তা ও অধিকার কি পাচ্ছে?
দেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে নারীর কাজের হার বেড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর প্রাধান্য লক্ষণীয়, রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব চোখে পড়ার মতো, কৃষিতে নারীর অবদান প্রায় পুরুষের কাছাকাছি।
খেলার মাঠে নারী, ব্যবসা চালাচ্ছে নারী, প্রযুক্তি খাতে বেড়েছে নারীর প্রবেশাধিকার, সংসার সামলাচ্ছে নারী এবং সেইসাথে দেশের সার্বিক এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে নারীর ভূমিকার কথাও গুরুত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে। গ্রাম বা শহর সবখানেই কাগজে-কলমে নারীর এগিয়ে যাওয়া চোখে পড়ার মতো। নারী দিবসে এই হিসাবটা যেন আরও জোরেশোরে করা হয়।
আজকের নারী ট্র্যাডিশনাল কাজের বাইরে নানাধরনের কাজের সাথে জড়িত হচ্ছেন জোর কদমে। যেমন—পুলিশে, সেনাবাহিনীতে, উড়োজাহাজ ও গাড়ি চালনা, পর্বতারোহণ, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞান, ফুটবল, ক্রিকেট, রেফারি, গ্লাইডার, সার্ফার, মাছ ধরা, কৃষিকাজ করা, শ্রমিক ইত্যাদি সবধরনের কাজে নারী এগিয়ে এসেছেন।
কিন্তু এরপরও সিংহভাগ নারীকে নানাধরনের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে। তাদের কারো না কারো ‘কেয়ারঅফে’ থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। একক নারী, নারীর একক পরিবার এবং একক মা—নারীর এই পরিচয়কে সমাজ করুণার চোখে দেখে।
উন্নয়ন ও আধুনিকতার এই ডামাডোলের মধ্যেও নারীকে একধরনের ভয়ের পরিবেশে চলাফেরা করতে হয়। ঘরে, বাইরে, পরিবহনে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীর যতই অর্জন থাকুক, কিন্তু নিরাপত্তা ও অধিকার নারী কতটা পাচ্ছেন?
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর সার্বিক উন্নতি হলেও এই একটা জায়গায় এসে যেন স্থবির হয়ে আছি আমরা। সেখানে গ্রামের একজন খেটে খাওয়া নিরক্ষর নারীও যা, শহুরে শিক্ষিত নারীও তা। সবসময়ই তাকে অন্যের আশ্রয়ে, প্রশ্রয়ে, শাসনে, শোষণে বাঁচতে হয়।
বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে পড়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে অনেক নারী প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হতেই পারেন না। নারী যতই যুদ্ধ করে এগিয়ে যাক না কেন, সমাজ তাকে পেছন থেকে টেনে রাখে।
উন্নয়ন ও আধুনিকতার এই ডামাডোলের মধ্যেও নারীকে একধরনের ভয়ের পরিবেশে চলাফেরা করতে হয়। ঘরে, বাইরে, পরিবহনে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীর যতই অর্জন থাকুক, কিন্তু নিরাপত্তা ও অধিকার নারী কতটা পাচ্ছেন?
অথচ ভারতের পুরনো ইতিহাস অন্য কথা বলে। সেদিন এক লেখায় পড়লাম ভারতবর্ষে পশ্চিমা আক্রমণের আগে (২৫০০ বছর আগে) নারী-পুরুষ সমঅধিকার ছিল। দক্ষিণ ভারতে যতগুলো পুরুষ দেবতার মন্দির ছিল, ততগুলোই নারী দেবতার মন্দির ছিল। পরবর্তীতে অন্য শাসকদের শাসনামলে নারীদের মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। তখন ধর্ম ছিল শিক্ষা ও জ্ঞানের অংশ। পরে বিদেশি আক্রমণ ধর্মকে করেছে রাজার দোসর বা হাতিয়ার। যার শুরু হয়েছে রোমান ইংল্যান্ড থেকে।
এত বছর পরে সেইসব আধুনিক দেশে নারীর একটা পরিচয় তৈরি হলেও ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে হয়নি। সমাজ নারীর অহংবোধ ও মর্যাদাবোধকে জাগ্রত হতে দেয় না। আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি না হলে একজন নারীর পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আরও কঠিন। এই সুযোগ গ্রহণ করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষেরা।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খাতে অনেককিছু অর্জন করেছে। বাংলাদেশের শ্রম বাজারে গত ২/৩ দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালে এসে তা হয়েছে ৩৬.৩ শতাংশ।
শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেশ বাড়ার পরও এই সংখ্যাগত হার পুরুষের চেয়ে অনেক কম। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, দেশের পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখনো যথার্থ দৃষ্টি পাচ্ছে না।
নারী তার সময়ের একটা বড় অংশ বাজারকেন্দ্রিক কাজের চেয়ে বাজার বহিভূর্ত কাজে ব্যস্ত থাকে। এই বিনামূল্যের গৃহস্থালি কাজগুলোকেই অ-অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অস্বীকৃত এবং অদৃশ্য কাজগুলো শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, শিশুর যত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্ন নয়। এর সাথে আছে কৃষিকাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা ও বীজ সংরক্ষণ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খাতে অনেককিছু অর্জন করেছে। বাংলাদেশের শ্রম বাজারে গত ২/৩ দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালে এসে তা হয়েছে ৩৬.৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন দেশে ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সাথে যুক্ত। পুরুষের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। দেশের জিডিপিতে মোট জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২০ শতাংশ। এই কাজগুলো কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গৃহিণীরা করে থাকেন। অথচ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ একে মূল্য দেয় না।
বহুদিন ধরেই বাংলাদেশে উপার্জনকারী হিসেবে নয়, বরং সংসারের মুখ্য উপার্জনকারী হিসেবে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। নারী ঘরের পুরোটা কাজ করছেন, বাইরেও উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু এরপরেও তাকে নিয়মিতভাবে নিপীড়িত হয়ে, বিচারহীন ও মর্যাদাহীন অবস্থার মধ্যে থাকতে হচ্ছে।
কিন্তু একটি আধুনিক ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র কাঠামোতে থাকতে হলে বাংলাদেশকে বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে হবে। এখন বৈশ্বিক এজেন্ডা হচ্ছে এমন সমাধান বের করা, যার মাধ্যমে নীতি বা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারীর অর্থনৈতিক কাজকে উৎসাহিত করা যায়। সেইসাথে এমন সুযোগ সৃষ্টি করা যেন নারী কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাজে যোগ দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। সেই সাথে নারীর নিরাপত্তা জোরদার করা, নারী শিক্ষা বৃদ্ধি, বাল্যবিয়ে রোধ ইত্যাদি বিষয়গুলোও আলোচিত হচ্ছে।
আমরা চাইছি শুধু কথায় নয়, কাজে নারীকে গুরুত্ব দেওয়া হোক, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। নারীবান্ধব অবকাঠামোগত বরাদ্দ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে জন্য এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে নারী সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়।
শাহানা হুদা রঞ্জনা ।। সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন