দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : মরে যাওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা কঠিন
পাপন বড়ুয়া শাকিল আমার ফেসবুকে পরিচিত। বন্ধু তালিকায় না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে ম্যাসেঞ্জারে টুকটাক কথা হয়েছে। হঠাৎ তার আইডি থেকে একটি বার্তা এলো। বার্তাটি পড়ে আমি থমকে গেলাম। বার্তাটি পাঠিয়েছেন পাপন বড়ুয়ার ছোট বোন সুবর্ণা তুলি বড়ুয়া।
জানালেন, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কাপ্তাই সড়কে এক দুর্ঘটনায় তার ভাই মারা গেছেন। তিনি এখন ভাইয়ের আইডিটি সচল করেছেন। নিজের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের লিঙ্ক পাঠিয়ে দেন। তুলির আকুতি, ‘দাদা আপনারা সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে সোচ্চার হোন।’ তুলি তার স্ট্যাটাসে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছেন, ‘আমার ভাইয়ের মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুর দায় কার?
আমার ভাইয়ের ৩ বছর ৪ মাস বয়সী মেয়ের বাবা হারানোর দায় কার?
আমার ভাইয়ের স্ত্রীর-এ দশার জন্য দায় কার?
আমাদের সব ভাইবোনের ভাই হারানোর দায় কার?
আমার দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ভাইকে হারানোর দায় কার?
আমার ভাইয়ের মতো একজন সাম্যবাদী, অহিংস, সৎ, সাহসী, লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক, নিরহংকারী, মেধাবী মানুষকে হারানোর দায় কার?
এ হত্যার দায় কার?’
তুলির এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আমার কাছে। ভাই হারানো বোনকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষাও আমি জানি না। তাই তার আকুতির কোনো জবাব দিতে পারিনি। বলতে পারিনি, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমরা বছরের পর বছর লিখছি, বলছি, মাঠে নেমে আন্দোলন করছি। ইলিয়াস কাঞ্চন তো স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর পর থেকে দুই দশক ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।
ঢাকার শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে অনন্য সাধারণ আন্দোলন করেছে। আন্দোলনে আইন বদলেছে। কিন্তু সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমেনি।
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না। বরং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে আয় কমে যাচ্ছে। যদিও সরকারের অসংবেদনশীল মন্ত্রীরা দাবি করছেন, মানুষের আয় বাড়ছে, তাই জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রথমে পাঁচ ভাই, পরে হাসপাতালে আরও এক ভাই মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পূর্বে সব ভাইবোন একসাথে হয়েছিলেন। ফিটনেসবিহীন একটি পিকআপ চালাচ্ছিলেন লাইসেন্স ছাড়া একজন চালক। তার খামখেয়ালিতে শূন্য হয়ে গেছে একটি পরিবার। এক দুর্ঘটনায় ছয় ভাইয়ের মৃত্যু হওয়া সেই পরিবার বা ভাই হারানো তুলির জন্য রাষ্ট্র কী সান্ত্বনার বাণী শোনাবে?
তুলি তার স্ট্যাটাস শেষ করেছেন একটি আহ্বান দিয়ে, ‘আসুন শোক নয়, সোচ্চার হই—নিরাপদ সড়কের জন্য।’ আসলেই আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। কঠোর আইন করলেই হবে না, আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। স্টিয়ারিং ধরার আগে যেন একজন চালক তার দায়িত্বটা বোঝে, দুর্ঘটনার শাস্তিকে যেন সে ভয় পায়।
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনই অমূল্য। কারণ বিজ্ঞান যতই আবিষ্কার করুক, মানুষকে জীবন দেওয়ার সূত্র এখনো পায়নি, কখনো পাবেও না। তাই জীবনের কোনো বিনিময় নেই, জীবন সত্যিই অমূল্য। কিন্তু বাংলাদেশের সড়ক দেখলে মনে হবে জীবনের কোনো দাম নেই। চাইলেই গাড়ি চাপা দিয়ে যে কাউকে মেরে ফেলা সম্ভব। কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই, শাস্তির ভয় নেই। স্টিয়ারিং হাতে যেন আজরাইল দাপিয়ে বেড়ায় সড়কে।
বাংলাদেশে মানুষের জীবন ছাড়া আর সবকিছুর দামই এখন বাড়তি। দুদিন আগে বাসায় ফিরেই নোটিশ পেলাম, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়েছে এবং সেটা এ মাস থেকেই কার্যকর। তার মানে গ্যাসের বিলে যোগ হচ্ছে বাড়তি চাপ। এই চাপ এখন বহুমুখী। পানির দাম বাড়ছি বাড়ছি করছে। বিদ্যুতের দামও দফায় দফায় বেড়েছে। ক’দিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী।
মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত এই বহুমুখী চাপে পিষ্ট এখন। ডুবতে ডুবতে কোনোরকমে নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে মানুষ। টিসিবির লাইন শ্রেণি বৈষম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। নিম্নবিত্ত মানুষের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে মধ্যবিত্তরাও এখন টিসিবির লাইন লম্বা করছেন। আসলে মানুষের উপায় নেই।
বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, ডিস বিল, সন্তানের পড়াশোনার খরচ তো নির্ধারিত। তাহলে বাড়তি ব্যয়টা মেটাবে কী করে? এই অঙ্ক জুয়েল আইচও মেলাতে পারবে না।
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না। বরং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে আয় কমে যাচ্ছে। যদিও সরকারের অসংবেদনশীল মন্ত্রীরা দাবি করছেন, মানুষের আয় বাড়ছে, তাই জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। তারা রেফারেন্স দিচ্ছেন, মাথাপিছু আয় বাড়াকে। কিন্তু মাথাপিছু আয় তো নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য শুভঙ্করের ফাঁকি।
সরকারি বা বেসরকারি, যে চাকরিই করুন; মাথাপিছু আয় যতই বাড়ুক; সেই মানুষটির আয় বাড়ার কিন্তু কোনো সুযোগ নেই। বরং বেসরকারি চাকরিজীবী অনেকের বেতন করোনার সময় কমে গেছে। আয় বাড়ার কোনো সুযোগ ছাড়াই বাজারে যখন আগুন লাগে, তখন মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না।
বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, ডিস বিল, সন্তানের পড়াশোনার খরচ তো নির্ধারিত। তাহলে বাড়তি ব্যয়টা মেটাবে কী করে? এই অঙ্ক জুয়েল আইচও মেলাতে পারবে না।
মানুষ আসলে তখন কী করে? পরিবার নিয়ে মাসে একবার রেস্টুরেন্টে যাওয়ার বিলাসিতা বাদ দেয়। চিকন চাল থেকে মোটা চালে জাম্প করে। দুধ-ডিম কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে দেয়। মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়, এই অজুহাত দিয়ে শাকসবজির দিকে মনোযোগ দেয়। কিন্তু শাকসবজির দামও কিন্তু সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
ভোজ্যতেল নিয়ে বাজারে রীতিমতো তেলেসমাতি চলছে। ক’দিন আগেই দাম এক দফা বেড়েছে। আরেক দফা বাড়ানোর প্রস্তাব সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু সেই প্রত্যাখ্যানে বাজারের কিছু যায় আসে না। সয়াবিন তেলের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
বাণিজ্যমন্ত্রী আগেই বলে দিয়েছেন, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে তার কিছুই করার নেই। জ্বালানি তেল হোক আর ভোজ্যতেল, দাম বাড়ানোর অজুহাত তৈরি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু চাল, মাছ, মাংস, সবজির মতো পণ্যের দাম বাড়ছে কেন? এই প্রশ্নের জবাব কী দেবেন বাণিজ্যমন্ত্রী। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাংলাদেশের বাজার যেন সত্যিকারের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। নিয়ন্ত্রণ যদি না-ই থাকে, তাহলে আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের থাকার দরকার কী।
বাজারের এখনকার দশা দেখে আমি রীতিমতো শঙ্কিত। এখনকার অবস্থাতেই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস। রমজান আসতে একমাসেরও কম সময় বাকি। সংযমের মাস এলেই আমাদের বাজারের সংযমের বাধ ভেঙে যায়।
এবার এখনই যা অবস্থা, রমজান এলে কী হবে কে জানেন। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন মরে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ; আর বেঁচে থাকাটা কঠিন, প্রতিদিনের যুদ্ধ।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ