টিকা কেন গণমুখী হচ্ছে না?
টিকায় বিশ্ব মুকুট প্রাপ্ত দেশ করোনা টিকাদানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাবে না, এটা আদৌ কাঙ্ক্ষিত নয়। পরীক্ষিত ক্লাস খেলোয়াড় ঘরের মাঠে মুখ থুবড়ে পড়বে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। চার দশক ধরে নবজাতক শিশু-কিশোরী মায়েদের মন জয় করেছে ইপিআই কর্মসূচি। গাঁও গেরামের মানুষদের করোনা টিকাদানে ব্যর্থতার কারণ আমাদের করোনা টিকাদান ক্রীড়ার জাতীয় কোচ, ব্যবস্থাপকদের ভুল কৌশল, ভুল পদ্ধতি নির্বাচন।
সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সক্ষম জাতীয় কর্মসূচি ইপিআইয়ের প্রতি একধরনের কালিমা লেপিত হলো এবং করোনা টিকাদান কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে ব্যর্থ হলো।
কেন করোনা টিকা গণমুখী হলো না, অসংখ্য মানুষ টিকা বহির্ভূত থাকল, ইপিআই টিকাদান প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দেড়মাস বয়সী শিশু থেকে গর্ভবতী মহিলাদের মেলবন্ধনে যুক্ত করতে পারলেও কেন আমাদের বয়স্কদের তা করা গেল না, তার কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করা যেতে পারে। করোনা টিকাদান কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় আনা যায়।
বাংলাদেশে ইপিআই কর্মসূচি দশক ধরে সফলভাবে চলছে জাতীয় পর্যায়ে ইপিআই কর্মসূচির ‘কর্মসূচি সংগঠক’ বা প্রোগ্রাম ম্যানেজারের নেতৃত্বে। করোনাকালে একজন চৌকস কর্মকর্তা, যিনি মাঠ পর্যায়ে মেডিকেল অফিসার, ইউএইচএফপিও (উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা) এবং সিভিল সার্জন হিসেবে ওতপ্রোতভাবে ইপিআই কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন এবং উপজেলা ও জেলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি ছিলেন ঐ পদে কর্মরত। তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দশ লক্ষাধিক মানুষদের ইপিআই ও কলেরা টিকাদানে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
কেন করোনা টিকা গণমুখী হলো না, অসংখ্য মানুষ টিকা বহির্ভূত থাকল, ইপিআই টিকাদান প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দেড়মাস বয়সী শিশু থেকে গর্ভবতী মহিলাদের মেলবন্ধনে যুক্ত করতে পারলেও কেন আমাদের বয়স্কদের তা করা গেল না
স্বাভাবিকভাবে এই ক্ষেত্রেও তার করোনা টিকাদান সফল না করার কারণ ছিল না। সমস্যা হয়েছে, তার উপরে অতি খবরদারি একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তাকে স্বাভাবিক নেতৃত্বদানে অন্তরায় সৃষ্টি করা। খবরদারির দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের না আছে ইপিআই কর্মসূচির অভিজ্ঞতা, না আছে দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা। ফলে তারা একাধিক অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অকার্যকর পরিকল্পনা নিয়েছেন।
আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অধস্তন কর্মকর্তাদের মতামত দেওয়ার অধিকার সীমিত, ভিন্নমত পোষণ প্রায় অসম্ভব; সুতরাং উপর থেকে চাপানো সিদ্ধান্তগুলো অসম্ভব মনে হলেও তাকে গলাধকরণ করতে গিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে তার দীর্ঘদিনের সফলতার ধারাবাহিকতায়, করোনা টিকাদানের সুবাদে।
নেতৃত্বদানের সমস্যা শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও তার অনুরূপ ভ্রান্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণেও বিঘ্নিত হয়েছে করোনা টিকাদানের সফলতা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন ও ইউএইচএফপিওর পরিবর্তে ডিসি ও ইউএনওদের জেলা ও উপজেলা প্রধান করে করোনা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনের সিদ্ধান্ত করোনা টিকাদান সফলভাবে বাস্তবায়নের অন্তরায় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
কোটি কোটি মানুষকে টিকা প্রদানের জন্য পরিচালক, সিভিল সার্জন ও ইউএইচএফপিওদের প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ যথাসময়ে যথেষ্ট পরিমাণে না পাওয়ায় তাদের এই বিশাল কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে পালনে হোঁচট খেতে হয়েছে বারবার।
করোনা টিকাদানে দুটি আশ্চর্য সিদ্ধান্ত ছিল, ১. অনলাইন নিবন্ধন এবং ২. সীমিত সংখ্যক টিকা কেন্দ্রের মাধ্যমে পরীক্ষিত টিকাদান কর্মীদের বাদ দিয়ে টিকাদানের সিদ্ধান্তে গ্রহণ।
ইপিআই টিকাদান সফলভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে স্বাস্থ্য সহকারীদের মাধ্যমে খানায় খানায় গিয়ে শিশু ও মা’দের নিবন্ধনের মাধ্যমে। আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্য কাঠামোতে প্রান্তিক মাঠকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এত নিবিড়ভাবে বিস্তৃত যে অতি সহজে খানায় খানায় গিয়ে খানা সদস্যদের তালিকাভুক্তি করা যেত এক দুই সপ্তাহের মধ্যেই। এখানে একসাথে দুটো কাজ হতো; উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর তালিকা ও সংখ্যা এবং আন্তব্যক্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার জনগোষ্ঠীকে তাদের স্থানীয় ভাষায় তাদের মতো করে করোনা টিকা নিতে উদ্বুদ্ধকরণ।
অ্যাপস বা অনলাইনের মাধ্যমে নিবন্ধনের সিদ্ধান্তে এই দুটি কাজই বিঘ্নিত হয়েছে; প্রথম পর্যায়ে টিকা প্রার্থী পঞ্চাশোর্ধ গ্রামীণ নিরক্ষর মানুষদের টিকা বঞ্চনা। তারমূল্য দিতে হয়ে সেসব মানুষদের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা অসংখ্য সংখ্যায় আক্রান্ত হয়ে এবং তাদের অনেককে অহেতুক জীবন বিসর্জন দিয়ে। তাদের অনেকেই এখনো টিকার আওতায় আসেনি এবং আমরা জানতে পারছি না, কে টিকা নেয়নি।
আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, গ্রামের বয়স্ক নিরক্ষর দরিদ্র মানুষদের তথ্য প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়, ইউনিয়ন পর্যায়ে যে নিবন্ধনের সুযোগের কথা জোরেশোরে প্রচার করা হয়েছিল, তা বাস্তবসম্মত ছিল না ফলে তাই প্রমাণ হয়েছে। অ্যাপস, অনলাইন নিবন্ধের বিপক্ষে আমরা মিডিয়াতে সুস্পষ্টভাবে অসংখ্যবার মতামত রেখেছি, তা হালে পানি পায়নি।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর টিকা গ্রহণের আরেকটি অন্তরায় ছিল টিকাদান কেন্দ্রের সংখ্যা স্বল্পতা। একটি উপজেলার প্রায় পাঁচ লক্ষ জনগণের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি মাত্র টিকা কেন্দ্র আদৌ যথেষ্ট ছিল না। উপজেলা সদর থেকে দূরবর্তী জনপদে বসবাসরত মানুষের লোক চক্ষুর আড়ালে চলেছে করোনা টিকা কার্যক্রম।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর টিকা গ্রহণের আরেকটি অন্তরায় ছিল টিকাদান কেন্দ্রের সংখ্যা স্বল্পতা। একটি উপজেলার প্রায় পাঁচ লক্ষ জনগণের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি মাত্র টিকা কেন্দ্র আদৌ যথেষ্ট ছিল না।
একদিকে গ্রামীণ মানুষের টিকাদানের আগ্রহের কমতি অন্যদিকে, দূরবর্তী হওয়ায় টিকা নিতে আসার জন্য শ্রমদিবস হারানো এবং উপরন্তু যাতায়াত খরচ তাদের টিকা গ্রহণে অন্তরায় হয়েছে। আমাদের যাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে এবং জাতীয় পর্যায়ে অনুরূপ গণস্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনা করেছি, তাদের এই অন্তরা সমূহ বুঝতে সময় লাগেনি এবং করোনা টিকাদানের প্রথমদিকে আমরা এই বাধাগুলো সম্পর্কে সজাগ করার চেষ্টা করেছি।
আমাদের উদ্বেগগুলো আমলে শেষ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে, যখন প্রমাণিত হয়েছে যে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ টিকার বাইরে থেকে যাচ্ছে, তারা ডেল্টা ও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে অধিকতর মারাত্মক সংক্রমণে ভুগেছেন এবং প্রাণ দিচ্ছেন। পরিবর্তিত পরিকল্পনাও যথাযথভাবে প্রণীত হলো না।
এখন প্রয়োজন ছিল, কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক খানা জরিপের মাধ্যমে টিকা বহির্ভূত ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়ন করে কমিউনিটি ক্লিনিকে টিকাদান। এই তালিকা করা কঠিন কোনো ব্যাপার ছিল না, এখনো তা সম্ভব।
স্বাস্থ্য সহকারী, সিএইচসিপি, এনজিও কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী সমন্বিত ৪/৫ জনের দলের দেড় থেকে দুই হাজার খানায় জরিপ করতে ৪/৫ দিনের বেশি লাগবে না। পাশাপাশি বাদ পড়া ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা যাবে এবং নির্দিষ্ট দিনে তাদের টিকাদান করা শতভাগের কাছাকাছি সম্ভব করা যাবে। আমাদের পনেরো হাজারের মতো কমিউনিটি ক্লিনিকের একেকটির আওতায় খুব বেশি লোক করোনা টিকা হতে বাদ গেছে তা নয়, সুতরাং এটা সম্ভাব্য একটি কার্যক্রম হতে পারে।
সম্প্রতি আরেকটি ঘোষণা এসেছে যে, ২৬ ফেব্রুয়ারির পর শেষ প্রথম ডোজ টিকা। তার মানে এরপর চাইলে বা বাদ থাকলেও তারা আর করোনা টিকা সুরক্ষার বলয়ে ঢুকতে পারবেন না। এটা কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না, এর মধ্যে কোনো তথ্য উপাত্তের ব্যবহার নেই, নেই রোগতাত্ত্বিক বিবেচনা।
কোন বয়সে, কতসংখ্যক লোক, কোথায় বাকি আছে, তার কোনো হিসাব নেই আমাদের কাছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে অতীব ঝুঁকিপূর্ণ রোগাক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিরা যদি বাদ পড়ে যান, বাদ পড়ার কারণ তারা নিজেরা নন; তাহলে এত অর্থ ব্যয়ের পরও দেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর করোনা টিকার সুরক্ষা থেকে বাদ পড়ে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। বরং পরিকল্পনা করা উচিত বাদ পড়া ঝুঁকি মানুষদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যাকে অতি সত্ত্বর করোনা টিকার আওতায় আনার; করোনা টিকায় তাতে বাংলাদেশ সাফল্যের দাবিদার হতে পারবে। ঝুঁকিপূর্ণ রোগ আক্রান্ত গ্রামীণ ৫০/৬০ ভাগ মানুষকে টিকা সুরক্ষার বাইরে রেখে সেই সাফল্য লাভের দাবি কালিমা লিপ্ত হবে।
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক