পিলখানা হত্যাকাণ্ড : জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড
সেই সকালটা ভুলবো না কখনো। আমি তখন এনটিভিতে। সেদিন সকালেই ডিউটি ছিল। অফিসে গিয়ে শুনি পিলখানার দিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ বললো, বিডিআর সপ্তাহ চলছে, হয়ত কোনো কুচকাওয়াজের অংশ। তবু সন্দেহ যায় না।
সন্দেহ দূর করতেই বাঘা ক্রাইম রিপোর্টার পারভেজ খানকে ফোন করলাম। তার বাসা আজিমপুর, পিলখানার পাশেই। তিনি আওয়াজ শুনলেন এবং ছাদ থেকে দেখে বললেন, ‘কিছু একটা বড় গড়বড় হইছে মনে হয়।’ সেই শুরু। তারপর দুই দিন গোটা জাতি কাটিয়েছে থ্রিলার সিনেমার টানটান উত্তেজনায়, যার শেষটা ছিল ট্র্যাজিক।
শুরুতে যেটাকে বলা হচ্ছিল বিডিআর বিদ্রোহ, দুদিন পর জানা গেল বিদ্রোহ-টিদ্রোহ কিছু নয়, বিদ্রোহের নামে বিডিআর সৈনিকরা আসলে নির্মম হতাযজ্ঞ চালিয়েছে। ৫৭ জন্য চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের জীবন কেড়ে নেওয়া সেই ঘটনাটি বাংলাদেশের ইতিহাসেই সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনার একটি।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একসঙ্গে দুটি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় নিম্ন আদালতের রায় হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের পর হত্যা মামলা এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে বিস্ফোরক আইনে করা অপর মামলায় এখনো সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি। আগেই বলেছি, সরকার মানবিক বলে এবং সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা পরায়ণ বলে এখনও হত্যাযজ্ঞে জড়িতরা বিচারিক সুরক্ষা পাচ্ছেন। এ জন্য সরকার এবং সেনাবাহিনী অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে।
আজ এই ১৩ বছর পর এসেও আমি উত্তর পাই না, বিডিআর জওয়ানরা সেদিন আসলে কী করতে চেয়েছিল। শুরুতে বিডিআর জওয়ানদের কথা শুনে তাদের বঞ্চিত, নিপীড়িত মনে হচ্ছিল; তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ায়ও যৌক্তিকতার প্রলেপ ছিল। কিন্তু দুদিন পরই দেখা গেল তারা রক্তপিপাসু খুনি ছাড়া আর কিছু নয়। আর মানুষ মেরে কি কখনো দাবি আদায় করা যায়? আমার আরেকটি কৌতূহল, কখনো কখনো মানুষের বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। কিন্তু সেটা এক দুজনের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। একসঙ্গে হাজারখানেক মানুষ কীভাবে উন্মাদ হয়ে যেতে পারে! যখন ঠান্ডা মাথায় নিজেদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হত্যা করছিল, তখন কি তারা নিজেদের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করেনি? তাদের মধ্যে এমন একজন মানুষও কি ছিল না, যে পরিণতি সম্পর্কে তাদের সতর্ক করতে পারে। তারা কি আশা করেছিল, একের পর এক হত্যা করলে তাদের দাবি মানা হবে। সরকার অনেক মানবিক, সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা পরায়ণ বলেই তারা এখনও বেঁচে আছে।
স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাচ্ছেন, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাচ্ছেন, কারো কারো ফাঁসির রায় বদলে যাবজ্জীবন হচ্ছে, কেউ খালাস পাচ্ছেন। কিন্তু সেদিন যদি সেনা অভিযান হতো, বিদ্রোহের সাথে সাথে সেদিন তাদের জীবনেরও সমাধি হয়ে যেত। সত্যি বলতে কি এমন অপরিণামদর্শী, লক্ষ্যহীন হত্যাযজ্ঞের উদাহরণ খুব বেশি নেই।
বেদনায় হৃদয় যতই আর্ত হোক, আমরা সবসময় বিডিআর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ন্যায়বিচার চেয়েছি। যারা অপরাধী তারা সবাই যেন সাজা পায়, কিন্তু কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার মৌলিক ধারণাটাও হলো, ১০ জন অপরাধী পার পেয়ে যাক, একজন নিরপরাধও যেন সাজা না পায়।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একসঙ্গে দুটি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় নিম্ন আদালতের রায় হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের পর হত্যা মামলা এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে বিস্ফোরক আইনে করা অপর মামলায় এখনো সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি। আগেই বলেছি, সরকার মানবিক বলে এবং সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা পরায়ণ বলে এখনও হত্যাযজ্ঞে জড়িতরা বিচারিক সুরক্ষা পাচ্ছেন। এ জন্য সরকার এবং সেনাবাহিনী অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে।
বেদনায় হৃদয় যতই আর্ত হোক, আমরা সবসময় বিডিআর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ন্যায়বিচার চেয়েছি। যারা অপরাধী তারা সবাই যেন সাজা পায়, কিন্তু কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার মৌলিক ধারণাটাও হলো, ১০ জন অপরাধী পার পেয়ে যাক, একজন নিরপরাধও যেন সাজা না পায়।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি যেমন নজিরবিহীন, মামলাটিও। হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছিল ৮৫০ জনকে। বাংলাদেশে আর কোনো মামলায় এত আসামি ছিল না। রায়টাও নজিরবিহীন। নিম্ন আদালত ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল। খালাস পেয়েছিলেন ২৭৮ জন।
হত্যা মামলা আর বিস্ফোরক মামলা একই দিনে দায়ের করা হয়েছিল। একটি আপিল বিভাগে চলে গেছে, আরেকটির এখনও সাক্ষ্যগ্রহণই শেষ হয়নি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মতো চাঞ্চল্যকর মামলা যদি ১৩ বছরে সাক্ষ্য শেষ না হয়, তাহলে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা রাখবে কীভাবে? আইনের ভাষায় দুটি কথা আছে- 'জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড', আর 'জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড'। মামলার বিচারকাজ দ্রুত হলেও ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হতে পারে। আবার দেরি হলেও বিচারপ্রার্থী বঞ্চিত হতে পারেন।
দুটি মামলায় ভিন্ন গতির কারণে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন অন্তত ৫০০ আসামি। হত্যা মামলায় বেকসুর খালাস হওয়া বা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ভোগ শেষ করা এমন অন্তত ৫০০ ব্যক্তি এখনও মুক্তি পাচ্ছেন না, কারণ তারা বিস্ফোরক মামলারও আসামি। যেহেতু তারা হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন বা কম সাজা পেয়েছেন, তাই বিস্ফোরক মামলায়ও তাদের লঘুদণ্ডই পাওয়ার কথা।
বিডিআর হত্যার ঘটনায় বিচার বিলম্বিত হওয়ায় অনেকগুলো সমস্যা হচ্ছে। প্রথম কথা হলো যারা নিহত হয়েছেন, তাদের স্বজনরা বিচারের অপেক্ষায় আছেন। হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে রায় হলেও সে রায় কার্যকর পর্যায়ে যেতে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে? আবার যারা আসামি তারাও ১৩ বছর ধরে কারাগারে আছেন, কবে বিচার শেষ হবে সে অপেক্ষায়। এই সময়ে অন্তত ৫০ জন আসামি মারা গেছেন। বিচারাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া দোষী হলেও মারা যান অভিযুক্ত হিসেবে। আবার এমনও হতে পারে, বিচার শেষে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন।
তবে এই ঘটনায় দুটি মামলায় ভিন্ন গতির কারণে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন অন্তত ৫০০ আসামি। হত্যা মামলায় বেকসুর খালাস হওয়া বা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ভোগ শেষ করা এমন অন্তত ৫০০ ব্যক্তি এখনও মুক্তি পাচ্ছেন না, কারণ তারা বিস্ফোরক মামলারও আসামি। যেহেতু তারা হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন বা কম সাজা পেয়েছেন, তাই বিস্ফোরক মামলায়ও তাদের লঘুদণ্ডই পাওয়ার কথা। এরই মধ্যে তারা ১৩ বছর ধরে কারাগারে আছেন। বিস্ফোরক মামলার যে গতি তাতে হয়ত বিচার শেষ হতে ২০ বছর লাগবে। এখন ২০ বছর কারাগারে থাকার পর আদালত যদি কাউকে বেকসুর খালাস দেন, তাহলে তার এই ২০ বছর কে ফিরিয়ে দেবে। বা ২০ বছর কারাভোগের পর কারো যদি ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়, সেটা শুনতে হাস্যকর লাগবে।
সরকারকে যে কোনো উপায়ে দ্রুত গতিতে এই মামলার বিচার শেষ করতে হবে। স্বজন হারানো মানুষ যাতে অপরাধীদের শাস্তি দ্রুত কার্যকর দেখতে পান। আবার অভিযুক্তরাও যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ