বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্ট, জালিয়াতি করে কোটি টাকা আদায়
আগামীকাল আপনার ওমানের ফ্লাইট। কিন্তু আপনার করোনা টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। রিপোর্টটি নেগেটিভ করতে হলে ১০ হাজার টাকা এ নম্বরে বিকাশ করুন। এরপর পরিবর্তিত হবে আপনার রিপোর্ট।
এভাবে বিদেশগামীদের ফোন করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় র্যাব।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া প্রত্যেক যাত্রীর করোনা টেস্টের নেগেটিভ রিপোর্ট নেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে নমুনা দেওয়ার পরপরই এভাবেই ফোন আসত প্রবাসীদের কাছে। প্রতারণার মাধ্যমে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করত চক্রটি।
র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ ফল প্রাপ্তির আশ্বাস দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। আত্মসাৎ করা বিপুল অর্থ ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ অবৈধ সিমসহ কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাজধানী ঢাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গ্রেপ্তার হওয়া প্রতারকরা হলেন; মো. জসিম উদ্দিন, মো. সুলতান মিয়া, মো. বেলাল হোসেন, মো. আবুল হোসেন, মো. আবদুল নুর, মো. আলফাজ মিয়া, মো. শামিম, মো. আহাম্মদ হোসেন, মো. ইমরান উদ্দিন মিলন, মো. সবুজ মিয়া, মো. আব্দুর রশিদ, আব্দুল করিম চৌধুরী, মো. আঙ্গুর মিয়া ও মো. আলমগীর হোসেন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০টি সিম কার্ড, সিম অ্যাক্টিভেট করার ১টি ফিঙার প্রিন্ট মেশিন, ১টি ট্যাব, ৩২টি মোবাইল, ১টি পাসপোর্ট ও নোটবুক জব্দ করা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, চক্রের মূলহোতা বেলাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি ২০২১ সালের মার্চ মাসে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য কুমিল্লার একটি হাসপাতালে করোনা টেস্ট করার পর অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ওই হাসপাতালের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে তার করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে বলে জানায়। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলালের করোনা টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ করার প্রতিশ্রুতি দিলে বেলাল ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন। পরবর্তীতে তার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। বিষয়টি জানতে তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই নামে কেউ নেই বলে জানায়।
এরপর নিজেই এ প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। যা বাস্তবায়ন করতে বন্ধু সবুজকে সঙ্গে নিয়ে একটি চক্র তৈরি করেন তিনি। প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা সমানভাগে বণ্টনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বিদেশ চলে যান। ৪ মাস পর আগস্টে দেশে আসেন বেলাল। তিনি চক্রের সদস্যদের বিভিন্ন জেলায় বিদেশগামীদের ফোন নম্বর সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, আব্দুর নূর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আহাম্মেদ হোসেন চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুর রশিদ রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুল করিম কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়; আলমগীর সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায়; আঙ্গুর মিয়া কুমিল্লা, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় সরকার নির্ধারিত বিদেশগামীদের করোনা টেস্ট হাসপাতালসমূহে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদেশগামী যাত্রী ছদ্মবেশে অবস্থান করে কৌশলে অন্য যাত্রীদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন।
নম্বরগুলো সংগ্রহ করে বেলাল ও সবুজকে পাঠানো হতো। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফল হাতে পাওয়ার পূর্বেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা বিভাগের ডাক্তার/হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীদের নম্বরে কল দিয়ে করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে বলে মিথ্যা তথ্য প্রদান করতেন। পরে পজিটিভ রেজাল্ট নেগেটিভ করে দেওয়ার কথা বলে প্রত্যেক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিত।
আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নম্বর প্রদান করত এবং ভুক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজের কথা অনুযায়ী ওইসব নম্বরে টাকা পাঠালে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান উপস্থিত থেকে তা সংগ্রহ করত। ভুক্তভোগীর অবস্থান ও টাকা সংগ্রহের অবস্থান সবসময় ভিন্ন ভিন্ন জেলায় নির্ধারণ করা হতো, যাতে কেউ কোনো কিছু আঁচ করতে না পারে। গ্রেপ্তার আসামিরা একটি সিম এক দিন ব্যবহার করে তা কিছুদিন বন্ধ রেখে পুনরায় ব্যবহার করত এবং কোন নম্বর নিয়ে সন্দেহ হলে তা ফেলে দিত। প্রতারণার এই পদ্ধতি সম্পন্ন করার জন্য মো. মিলন খোলা বাজারের ১২০ টাকার সিম ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলাল ও সবুজকে দিতেন।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রতারক চক্রের সদস্যরা কেউ প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হননি। তারপরও অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সু-কৌশলে শত শত মোবাইল সিম নামে বেনামে উত্তোলন করে প্রতারণা করে আসছিল। গ্রেপ্তার সবুজ মিয়া র্যাবকে জানান, প্রতারণার মাধ্যমে তিনি গত ১০ মাসে হাজারের অধিক বিদেশগামী যাত্রীর কাছ থেকে এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটি আলিশান ভবন তৈরি করছেন। অন্যদিকে কাজী মো. বেলাল হোসেন ৬ শতাধিক বিদেশগামী যাত্রীর কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অন্যদের মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা বেতন দিতেন তিনি।
এআর/এসকেডি