ভাষাশহীদ বরকত, জব্বার ও শফিউরের কবরের পাশে কিছুক্ষণ
দীর্ঘ ৭ দশক ধরে আজিমপুরের পুরাতন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মৃত্যুঞ্জয়ী বীর শহীদ আবুল বরকত, আ. জব্বার ও শফিউর রহমান। তাদের অনন্ত এই নিদ্রার শেষ জানে না কেউ। এই তিন জনের মধ্যে ভাষা শহীদ আবুল বরকত, আ. জব্বার ২১ ফেব্রুয়ারি এবং শফিউর রহমান ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
শহীদ আব্দুল জব্বার ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন অসুস্থ শাশুড়ির ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে। শাশুড়িকে হাসপাতালে ভর্তি করে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকার হুরমত আলীর কক্ষে ওঠেন।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে আ. জব্বার তাতে যোগ দেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাতেই মৃত্যুবরণ করেন। মহান ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় শহীদ আ. জব্বারকে ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) দেওয়া হয়।
ভাষা শহীদ আবুল বরকতও ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহন হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় ওই দিন রাত আটটায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ২০০০ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন।
তবে ভাষা সৈনিক শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের নির্বিচারে গুলির প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ মিছিলে আবারও গুলি চালায় পুলিশ। এতে গুলিবিদ্ধ হন শফিউর রহমান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মারা যান তিনি। ২০০০ সালে তাকেও একুশে পদক (মরণোত্তর) দেওয়া হয়।
অবশ্য এই তিন ভাষা শহীদ ছাড়াও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম, অহিউল্লাহ ও আবদুল আওয়ালকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লাশ দাফনের খাতায় অহিউল্লাহর নাম পাওয়া গেলেও তার কবর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সালাম ও আওয়ালের কবরেরও নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন। ভাষা শহীদ রফিকের মরদেহও অতি গোপনে দাফন করা হয়েছিল কবরস্থানের অসংরক্ষিত এলাকায়। এরপর এই কবর ভেঙে নতুন কবর বসানো হয়ে। আজও তার কবরটির কোনো চিহ্ন আবিষ্কার হয়নি।
সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আজিমপুরের পুরাতন কবরস্থান ঘুরে দেখা যায়, এই তিন ভাষা শহীদদের কবরে সকাল থেকেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সাধারণ মানুষজন। তবে খুব বেশি মানুষের আনাগোনা নেই তাদের সমাধি ঘিরে। তিনটি কবরে হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানের দক্ষিণ গেট দিয়ে প্রবেশ করে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে কালো টাইলসে বাঁধাই করা পাশাপাশি সমাহিত তিন ভাষা শহীদের কবর।
প্রথম কবরটি শহীদ আবুল বরকতের। বরকতের পাশেই কবি সুফিয়া কামালের কবর। তার একটু দূরে শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রহমানের কবর। বরকতের তিনটা কবর পরেই আব্দুল জব্বারের কবর। সেটিও কালো রঙের টাইলস দিয়ে বাঁধানো। তার তিন সারি সামনে খানিকটা সরু পথ পেরুলে আরেক ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের কবর। প্রতিটি কবরের পশ্চিম দিকে সাদা মার্বেল পাথরের ফলক। তাতে লেখা রয়েছে নাম, পরিচয়, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ লেখা।
শ্রদ্ধা জানাতে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা স্থানীয় বাসিন্দারা ছোট সময় থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে নানা কর্মসূচি কেন্দ্র করে বড় হয়েছি। বর্তমানে জীবনের প্রয়োজনে দেশের বাইরে থাকলেও সব সময় বাংলা ভাষার জন্য মন কাঁদে। তাই ফেব্রুয়ারি মাসকে কেন্দ্র করেই দেশে আসি।
সঙ্গে থাকা আরেকজন কানাডা প্রবাসী সালমা শারমিন বললেন, সব সময় গর্ববোধ করি কেননা পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছিলাম। তবে দুঃখবোধ হচ্ছে বাংলা এখনো সর্বজনীন হয়নি। নতুন প্রজন্মের যারা রয়েছে তাদের হাত ধরেই বাংলার সুফল আসবে এমন প্রত্যাশা করি।
দাদার হাত ধরে ভাষাসৈনিকদের কবর দেখতে আসা ছোট শিশু তোবা সরদার ও সোহাকেও দেখা গেল শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেও দেখা গেল শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।
আজিমপুর কবরস্থানের কর্মচারী শমসের আলী জানান, খুব বেশি একটা মানুষজনের আনাগোনা নেই এখানে। মাঝে মধ্যে শহীদদের অনেক আত্মীয়-স্বজনরা কবর জিয়ারত করতে আসেন। এছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরেই অন্যান্য মানুষজন আসেন।
প্রসঙ্গত, ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকেই কবরস্থানের উত্তর দিকের গেট (নিউ মার্কেট সংলগ্ন) ও দক্ষিণ দিকের গেট খোলা থাকে। ২০ তারিখ রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ভাষা শহীদদের কবরে ফুল দেয়া শুরু হয়। ২১ তারিখ দিনভর চলবে এ শ্রদ্ধা নিবেদন।
আরএইচটি/এসএম