ঋণখেলাপিরা যেন নির্বাচনে মনোনয়ন না পায় : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
স্বাধীনতাবিরোধী, ঋণখেলাপি, করখেলাপি, বিলখেলাপি, দুর্নীতিবাজরা যেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। সেই বিষয়ে নতুন নির্বাচন কমিশনকে দৃঢ় অবস্থান দেখাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে “আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের সদিচ্ছা” শীর্ষক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার বক্তব্যে বলেন, আর্থিক খাতে যোগ্যতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে।
ব্যাংকগুলো মধ্যরাতে সভা করে ঋণখেলাপিদের দায়মুক্তি দিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকতা বিরোধী উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে পরিমাণ ঋণ আদায় করা হয় তারচেয়ে অনেক বেশি অবলোপন করা হচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে ১০ শতাংশ ঋণখেলাপির যে তথ্য দেওয়া হয় সেটি সঠিক নয়। কোনো ঋণখেলাপি যাতে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের সদস্য হতে না পারে সে বিষয়ে ব্যাংক মালিকদের সতর্ক থাকতে হবে। একইসাথে ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে হবে। আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সদিচ্ছা ও যোগ্যতার অভাব রয়েছে। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এড়িয়ে চলে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের পাশাপাশি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন টেকসই হবে না। অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকে বাংলাদেশ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা দিনে দিনে ক্যান্সারের রূপ ধারণ করছে। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির পরিধি সংকুচিত করছে। আর্থসামাজিক খাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাবলেও আর্থিক খাতের অনিয়ম আমাদের জন্য একটি কালো অধ্যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সরকার গর্ববোধ করলেও ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা লজ্জিত হই। দেশে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে উন্নয়ন হচ্ছে আবার মহালুটপাটও হচ্ছে। দেশে আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় দুষ্টু ক্ষত হলো ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচার। অর্থপাচারে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সম্পৃক্ত।
তিনি বলেন, কোভিড মহামারির দেড় বছরে দুবাইয়ে আবাসন খাতে চীনকে পিছনে ফেলে পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশিরা। জানা গেছে, একশ্রেণির বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলারা শুধুমাত্র বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের জন্য গত দেড় বছরে বিনিয়োগ করেছে ২৮৮ কোটি টাকা। এছাড়াও দুবাইয়ের বিভিন্ন ব্যাংকে কী পরিমাণে টাকা বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে জমা করেছে এবং দুর্নীতির অর্থ বিনিয়োগ করেছে তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। বাংলাদেশ থেকে গত এক দশকে ৩২ জন ২৪ কোটি টাকা করে বিনিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে গোল্ডেন ভিসা সংগ্রহ করেছে। অভিবাসী ভিসা নামে এই সুবিধাটি অতিধনীরা নিয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে গোল্ডেন ভিসার নামে এই অর্থ কীভাবে গেল ? অন্যদিকে, ঋণ জালিয়াতির সংস্কৃতি থেকে যেন আমাদের আর্থিক খাত কোনভাবেই শৃঙ্খলমুক্ত হতে পারছে না। ঋণখেলাপির সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সরকার ঋণ জালিয়াতি ও বিদেশে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের নীতি গ্রহণ করলেও আর্থিক খাতের দুর্বৃত্তরা নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঋণখেলাপি হয়েও জামানতবিহীন এলটিআর সৃষ্টি করে এবং খাস জমি মর্টগেজ দিয়ে ঋণ নিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির দুর্বৃত্তরা।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করেন। সুপারিশগুলো হচ্ছে-
১. অর্থপাচার প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন।
২. দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সাথে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সকল দুর্নীতিবাজদের তালিকা জাতীয় সংসদসহ গণমাধ্যমে প্রকাশ।
৩. ব্যাংকিং খাতের আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ে ও অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করা।
৪. ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচার রোধে সর্বদলীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা।
৫. বড় বড় ঋণখেলাপিরা যাতে কেউ বিদেশে যেতে না পারে তার জন্য নৌবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরগুলোতে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রেরণ করা।
৬. রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ না দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে সুনামের সাথে কাজ করেছেন এমন দক্ষ পেশাদার ব্যক্তিকে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া।
৭. ব্যাংকিং খাতে অভিজ্ঞ নয় এমন ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ না দেওয়া।
৮. নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা।
৯. চরম লোকসানে নিপতিত ব্যাংকগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা।
১০. সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ও পাচারকারীদের নাম সংগ্রহের জন্য সমঝোতা চুক্তি করা।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সমান নাম্বার পেয়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকরা যৌথভাবে বিজয়ী হন। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলের মাঝে ট্রফি ও সনদপত্র বিতরণ করা হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন ড. এস এম মোর্শেদ, সাংবাদিক রেজাউল হক কৌশিক, সাংবাদিক কাবেরী মৈত্রেয় ও সাংবাদিক রিজভী নেওয়াজ।
এইচকে