কোথাও যেতে চাই না, এ দেশ ছেড়ে কি যাওয়া যায়?
বিশিষ্ট অণুজীববিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। অবস্থান করছেন ঢাকার অদূরে সাভারে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তিনি ঢাকায় আসেন। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পথে এবং ঢাকায় আসার পথে বাংলাদেশিদের আবেগ দেখে তিনি অশ্রুসিক্ত হয়েছেন।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শনিবার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম। তখন বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে পানের দোকানদার, চায়ের দোকানদার, কেবিন ক্রুসহ সবাই আমাকে আপনজনের মতো ভালোবাসা দেখিয়েছেন।’
‘এবারও দেশে আসার পথে বাংলাদেশ বিমানে সংশ্লিষ্টদের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। করোনাকালে সাধারণ মানুষ আমাকে চিনেছে। তাদের ভালোবাসায় আমার চোখে জল আসে। আমি এ দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। এ দেশ ছেড়ে কি যাওয়া যায়?’
করোনাভাইরাস শনাক্তে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবক দলের প্রধান ড. বিজন কুমার শীল। ওয়ার্ক পারমিট জটিলতায় ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি সিঙ্গাপুর ফিরে গিয়েছিলেন। পরে বাংলাদেশে কাজ করার জন্য ওয়ার্ক পারমিট পান ২০২১ সালের ২৭ জুলাই। অনুমতি পাওয়ার পর ভীষণ উচ্ছ্বসিত হন তিনি। আগামী ২৬ জুলাই পর্যন্ত পারমিটের মেয়াদ রয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ড. বিজন কুমার শীলকে বাংলাদেশে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে দুই বছরের জন্য কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন ড. বিজন। গত বছরের ২৮ জুলাই থেকে এ দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তার নিয়োগ নবায়ন হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি ২০২১ সালের ২৭ জুলাই থেকে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে আছি। গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে ছুটিতে গিয়েছিলাম। অতীতের কথাগুলো না বলাই ভালো। বিশেষতঃ ওয়ার্ক পারমিটের জটিলতা নিয়ে।’
ড. বিজন কুমার শীলের মূল বাড়ি নাটোরের বনপাড়ায়। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান সিঙ্গাপুরেই বসবাস করছেন। ২০০২ সালে সিঙ্গাপুরের সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এ অণুজীববিজ্ঞানী। সিঙ্গাপুরের অভিবাসন আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নিতে বাধ্য হন।
২০০৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সার্স ভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত গবেষণায় সিঙ্গাপুর সরকারের বিজ্ঞানী হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ড. বিজন। পরে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তিন বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের জুলাইয়ে। পরে সেপ্টেম্বরে তাকে সিঙ্গাপুরে ফিরে যেতে হয়।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমন শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। তখন করোনা শনাক্ত করার কিট সংকট তীব্র হয়। দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের পক্ষে কোভিড-১৯ রোগ শনাক্তে র্যাপিড কিট (জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট কিট) উদ্ভাবনের বার্তা জানান বিজন কুমার শীল। এতে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। তবে তার নেতৃত্বে উদ্ভাবিত কিট বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন দেয়নি।
বিজন কুমার শীল বলেন, ‘আবার ফিরে এসেছি। আমার ভালো লাগছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আবার কাজ করছি।’
ওমিক্রন নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন ড. বিজন।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়েও তিনি সম্প্রতি আলাপ করেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওমিক্রনের লক্ষণ বা উপসর্গ খুঁজে বের করা অনেকটাই কঠিন। কারণ সাধারণ সর্দি-জ্বর ও ফ্লু ভাইরাসের সঙ্গে এটি অনেকটাই মিশে গেছে। কারণ হলো ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির অসংখ্যবার মিউটেশন (রূপ পরিবর্তন) হয়েছে। ফলে বেশকিছু ভেরিয়েশন আমরা দেখতে পেয়েছি। শুরুতে আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা আর এখন ওমিক্রন।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহের সাথে অনেকটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এর ফলে কিন্তু ভাইরাসটির উপসর্গেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। শুরুর দিকে আমরা জানতাম করোনা মানেই কাশি আর শ্বাসকষ্ট। আমরাও শুরু থেকে এমনটাই দেখেছি। কিন্তু এখন ওমিক্রন আমাদের যে ধরনের উপসর্গ দেখাচ্ছে, তা অনেকটা ঠান্ডা লাগার যে কিছু উপসর্গ হয়, অনেকটা সেরকমই। যে কারণে সাধারণ মানুষ অনেকটাই কনফিউজড (বিভ্রান্ত) আসলেই এটি ওমিক্রন নাকি সাধারণ ঠান্ডা, যা আমরা শীতকালে দেখে থাকি!’
বিশিষ্ট এ অণুজীববিজ্ঞানী বলেন, ‘কীভাবে ওমিক্রনকে দ্রুত চেনা যাবে বা এর লক্ষণ-উপসর্গ কেমন, বিষয়টি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলছে। কিন্তু সাধারণত ভাইরাস যখন মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়, তখন তার উপসর্গ নির্ভর করে ভাইরাসটি দেহের কোন টিস্যুকে ড্যামেজ করছে। যেমন ডেল্টা ধরন সাধারণত ওই স্থানে অ্যাটাক করত, যেখানে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের এক্সচেঞ্জ হতো। যে কারণে ডেল্টায় আক্রান্ত হলে মানুষের কাশি ও শ্বাসকষ্ট বেশি হতো। কিন্তু ওমিক্রনে ম্যাসিভ মিউটেশনের জন্য কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি এ পর্যন্ত ওমিক্রনেরই ১৫টি মিউটেশন হয়েছে, যা ডেল্টাতে হয়েছে মাত্র দুটি। এত পরিমাণ মিউটেশনের ফলে ওমিক্রন আমাদের শ্বাসতন্ত্রের একটু উপরিভাগে অবস্থান করছে। ফলে সাধারণ ফ্লু ভাইরাসে যে ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়, ওমিক্রনেও প্রায় সেগুলোই দেখা দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত ওমিক্রনের যেসব উপসর্গ আমরা দেখেছি, তার অন্যতম হলো নাক দিয়ে পানি পড়া, এতে করে অনেক সময় নাক বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও গলার মধ্যে খুসখুস করে। ফ্লু ভাইরাসে কিন্তু প্রচুর ঠান্ডা-জ্বর হয়, ওমিক্রনে আবার জ্বরের চেয়ে মাথাব্যথাটা বেশি হচ্ছে। মাথাব্যথার সঙ্গে নাক নিয়ে পানি পড়া, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং গলার ভেতরে এক ধরনের চুলকানি অনুভূত হয়, সঙ্গে কাশিও হয়। এসব উপসর্গ দেখে ওমিক্রন সংক্রমণ বোঝা যায়।’
বিজন কুমার শীল বলেন, ‘যখন কোনো দেশে কোনো একটি রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে, অর্থাৎ এটি যখন মহামারি আকারে চলে যায়, তখন যদি ওই রোগের সঙ্গে অন্য কোনো রোগের উপসর্গ মিলেও যায়, তখন ধরা হয় যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে যাওয়া রোগই হয়েছে। কারণ, এ ভাইরাসটিই এখন সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে ছড়াচ্ছে। ওমিক্রনের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই, এর সঙ্গে এ মুহূর্তে অন্য কোনো রোগের উপসর্গের মিল থাকলেও ধরে নিতে হবে এটি ওমিক্রন।’
তিনি বলেন, ‘সবমিলিয়ে ওমিক্রন হলে আমি যতটুকু দেখেছি প্রচুর মাথাব্যথা হয়, এবং এরপরই শুরু হয় নাক থেকে পানি পড়া। একইসঙ্গে গলার মধ্যে খুসখুস করে। এসব উপসর্গ যদি থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ওমিক্রন হয়েছে।’
পিএসডি/আরএইচ