নতুন আইনে নির্বাচন কমিশন হবে শতভাগ আমলা-নির্ভর
সার্চ কমিটির বিধান রেখে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’। বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের ষোড়শ অধিবেশনে আইনটির ওপর আনা জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা বিলটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করেছেন।
জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে আলোচনা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, শামীম হায়দার পাটোয়ারি, পীর ফজলুর রহমান, বেগম রওশন আরা মান্নান, বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানা, গণফোরামের মোকাব্বির খান ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু।
বিরোধী অংশের সংসদ সদস্যরা মনে করেন, নতুন এ আইনের মাধ্যমে ইসি নিয়োগ হলেও তাতে বিতর্ক বন্ধ হবে না। তবে তাদের এমন দাবি মানতে নারাজ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শেষ পর্যন্ত বিরোধীদলীয় সাংসদের ২২টি সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে এ আইন পাস করা হয়।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আইনমন্ত্রী অনেক আগেই বলেছিলেন ইসি নিয়োগের আইন করতে অনেক সময় লাগবে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন সময় কেন লাগবে। সেটা লাগবে কারণ সংবিধানকে সংশোধন করতে হবে। সংবিধানকে সংশোধন না করে, ৪৮ এর ৩ ধারা বাইপাস করে কোনো আইন তৈরি করা যাবে না। যদি সেটা হয় তাহলে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। সময় লাগবে— এটা তিনি বুঝেই বলেছিলেন।
তিনি বলেন, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যদি কণ্ঠভোটে পাস করিয়ে দেন তাহলে এটা সব থেকে বাজে উদাহরণ হবে।
মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমরা আশা করেছিলাম বিলটা গণতান্ত্রিকভাবে আসবে। দেশে কি বিচারপতি আর আমলা ছাড়া বিশ্বাস করার মতো মানুষ নেই? রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কি বিশ্বাস করেন না? স্পিকারকে বিশ্বাস করেন না? সংসদ সদস্যদের কি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়?
তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় সাংবিধানিক পদের লোকগুলো সাংবিধানিক কাউন্সিল করে নিয়োগ করতে পারে। নেপালেও একই অবস্থা। কেন আমরা নই। আপনাদের (আওয়ামী লীগ) তো সেনানিবাসে জন্ম হয়নি। দেশ স্বাধীন করার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনারা কেন বিচারপতি আর আমলাদের ওপর নির্ভর করবেন? এ বিলের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি রাখেন কোনো আপত্তি নাই।
চুন্নু বলেন, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক যে দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে সেখানে, আমরা নিশ্চিত কোনো আমলাই দেওয়া হবে। সেই দুইজনের নিয়োগের ভার রাষ্ট্রপতির হাতে না দিয়ে স্পিকারকে দায়িত্ব দিন। আর সংসদের দুইজন সদস্যকে যেন রাখা হয়। তাতে কিছুটা হলেও আমরা বলতে পারব আমাদের অংশগ্রহণ আছে। সংসদ হচ্ছে সকল কর্মকাণ্ডের মূল। আর সেই সংসদের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না এটা খুবই দুঃখজনক।
শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ওয়েস্ট মিনিস্টার ফার্ম অব গভর্নমেন্ট যেখানে প্রধানমন্ত্রী সর্বময়। তিনি সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন নারীকে পুরুষ বানানো ছাড়া আর পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া। যদি সেটা মেনে নিয়ে এই আইন করে তাহলে ঠিক আছে। তবে রাষ্ট্রপতি শব্দটা কেন আনলাম, রাষ্ট্রপতি শব্দটা কেন দিলাম? আর যদি প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতার একটা অংশ রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে দেবেন যেটা সংবিধানের ৪৮ (৩) –এ দুটি ক্ষমতা দেওয়া আছে। তার সঙ্গে আর একটি ক্ষমতা দেবেন তাহলে সেটি স্পষ্ট করে বলতে হবে অর্থাৎ অনুচ্ছেদ (৪৮), (৯৫) এবং (৫৬) এর রেফান্সে আছে, তার সাথে ১১৮ যুক্ত করতে হবে। সংবিধান সংশোধন না করে আইন করা অসাংবিধানিক হবে।
রওশন আরা মান্নান বলেন, তাড়াতাড়ি এ আইন পাস করা ঠিক হবে না। তাহলে আবারও দেশে নানান বিতর্ক সৃষ্টি হবে।
বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, আইনের বিষয়ে জনগণের ধারণা একেবারে সুস্পষ্ট যে, সরকার আইন প্রণয়নের নামে জনগণের সঙ্গে প্রহসন করছে। ২০১৭ সালে ২৫ জানুয়ারি যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল, তার সঙ্গে এ আইনের খুব একটা অমিল নেই।
তিনি বলেন, আইন প্রণয়ন হয় জনগণের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুবিধার জন্য। কিন্তু যদি সেই আইন মানুষের কল্যাণের চাইতে অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে, যদি সে আইন যে প্রতিষ্ঠানের জন্য করা হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানকে যদি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, তাহলে সেটি করার চাইতে না করাই ভালো।
নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না বলে জানিয়ে হারুন বলেন, অবশ্যই আইনটি ৪৮(৩) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিতর্কের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানদের প্রধানদের বিতর্কের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যক্তিগুলো সকলেই প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগপ্রাপ্ত। তাই প্রধানমন্ত্রীর আনুগত্য করাই একেবারে দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সংবিধান প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিতর্কিত করবেন। জনগণ হতাশ, জনগণ এটি চায় না। জনগণের দাবি হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার অবশ্যই হতে হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।
রুমিন ফারহানা বলেন, ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন প্রণয়ন বাধ্যতামূলক। কিন্তু সব অংশীজনের মতামত ছাড়া তাড়াহুড়ো করে এত জনগুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাস করা আই ওয়াশের বেশি কিছু নয়। এই আইন যে শুধু বিএনপি বা অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয়, সুশীল সমাজ আইনজ্ঞ সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ অনেকেই এর কঠোর সমালোচনা করেছে।
তিনি বলেন, খসড়া আইনটির সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। এ কমিটিতে সরকারি দল সংসদের প্রধান বিরোধী দল, তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে একজন করে প্রতিনিধি যদি থাকত তাহলে স্বচ্ছতা থাকত। এখনকার মতো সেটিও কোনো স্বাধীন কমিশন হবে না, হবে সরকারের নির্বাচনবিষয়ক মন্ত্রণালয়। নিয়োগটি দিন শেষে হবে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দে। কমিশন গঠন করছেন নাকি সরকারের পছন্দের লোকদের বসাচ্ছেন স্পষ্ট নয়। সুতরাং সার্চ কমিটি গঠন থেকে কমিশন গঠন পর্যন্ত পুরোটাই অস্পষ্ট।
গণফোরামের দলীয় সাংসদ মোকাব্বির খান বলেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল সংবিধানের আলোকে এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে যেখানে দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত দলগুলাকে ডেকেছিলেন, আমরা সেখানে ১৭ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার আলোকে দাবি উত্থাপন করেছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম রাষ্ট্রপতি এবার হয়তো ব্যতিক্রম কিছু করবেন। কিন্তু যারা সংলাপে গিয়েছিলেন, তারা এ ধরনের আইন চাননি।
এইউএ/আরএইচ