বুড়িগঙ্গার পানিতে ব্যাপক তেল ও গ্রিজের উপস্থিতি
বুড়িগঙ্গা নদীতে যুক্ত হওয়া প্রত্যেকটি ড্রেন দিয়ে আসছে ডাইং কারখানার দূষিত পানি। যার প্রভাবে ওই এলাকায় নদীর পানির রঙ কালচে থেকে বেগুনি হয়ে গেছে। বাতাসে ভেসে আসে দুর্গন্ধ। যা ওই এলাকার সার্বিক পরিবেশও বিপন্ন করে তুলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গার পানিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফেনলের (এটি কার্বলিক অ্যাসিড হিসেবেও পরিচিত, একটি অ্যারোমেটিক জৈব যৌগ। ফেনলের আণবিক সংকেত: C6H5OH) উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নদীর পানিতে প্রাক বর্ষা মৌসুমে ০.১৪, বর্ষায় ০.৪৩৫ ও বর্ষাপরবর্তী সময়ে ০.২ পাওয়া গেছে। যদিও সাধারণত নদ-নদীর পানিতে এ পদার্থের আদর্শমান ০.০০২ এর তুলনায় বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত ফেনল শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গার পানিকে করে তুলেছে আরও বিষাক্ত এবং পানের অনুপযোগী। পানীয় জলে ফেনলের উপস্থিতি মানবদেহে ডায়রিয়া, লিভারে স্থায়ী রোগসহ নানা জটিলতা তৈরি করে।
সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর পানির দূষণ নিয়ে গবেষণা চালায় ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম। এ গবেষণায় দূষণের এ চিত্র উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণায় প্রাপ্ত ফল উপস্থাপন করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামপুর অংশের পানি দূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে। তিনটি ঋতুতেই (প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষাপরবর্তী সময় ) শ্যামপুরের পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ৪.৮, ৪.২ ও ২.৮, যার আদর্শমান ০.৫ এর চেয়ে বহুমাত্রায় বেশি। উচ্চমাত্রার অ্যামোনিয়া শ্যামপুরের পানিতে নাইট্রোজেন দূষণকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য দূষণীয়। শ্যামপুরের পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় তেল ও গ্রিজ পাওয়া গেছে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে তেল ও গ্রিজের পরিমাণ যথাক্রমে ২.৬, ১:৯, ৩৫.৬। পানিতে তেল ও গ্রিজের আদর্শমান ০.০১। তেল ও গ্রিজ নদীতে স্বাভাবিক আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে এবং পানির উপরিভাগে একটি আস্তরণ তৈরি করে।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, এ পরীক্ষায় প্রথমে পানির পিএইচ পরিমাপ করা হয়। দেখা গেছে, শ্যামপুর ডায়িং ইন্ডাস্ট্রির পানিতে পিএইচের মান প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে যথাক্রমে ৭.৬, ৬.৭ ও ৮.৫। পিএইচের আদর্শমান ৭ এর থেকে বেশি প্রদর্শন করলে তা ক্ষারধর্মী এবং কম প্রদর্শন করলে তা অনুধর্মী। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শ্যামপুরের পানি বর্ষার সময় অদ্রীয় ধর্ম প্রদর্শন করে। এছাড়া বর্ষার পূর্বে এবং বর্ষার পরে সেই পানি ক্ষারীয় ধর্ম প্রদর্শন করে। শ্যামপুরের পানিতে টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডসের পরিমাণ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে, তিন ঋতুতে যথাক্রমে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। পানিতে টিএসএসের আদর্শ মান ১০। দেখা যাচ্ছে শ্যামপুরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে টিএসএস বা টোটাল সাসপেন্ডেড সলিডস পাওয়া যায়, যা পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং পানির নিচে নদীতলে পাতলা আস্তরণ সৃষ্টি করে। যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
তিনি বলেন, প্রাকবর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা বা সিওডির পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই তিন ঋতুতে সিওডির পরিমাণ যথাক্রমে ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। যা আদর্শমান ৪ এর চেয়ে বহুগুণে বেশি। পরবর্তীতে জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা বা বিওডির পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিন ঋতুতে বিওডির পরিমাণ যথাক্রমে ৮৭, ৭২ ও ১০৬, যা আদর্শমান ০.২ এর তুলনায় অত্যধিক বেশি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় প্রকার অক্সিজেন ডিমান্ড অত্যন্ত বেশি, যা এই পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকাকে নির্দেশ করে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে ৩ দফা দাবি জানিয়ে বলা হয়, নদী দূষণে দায়ী ডাইং কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে; ডাইং কারখানাগুলোকে অবশ্যই বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে হবে এবং জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল।
এমএইচএন/এসকেডি