এবার শ্বাসকষ্টের রোগী আগের চেয়ে কম
নতুন বছরের শুরুতে চট্টগ্রামে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এর সঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাকেই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন চিকিৎসকরা। আবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেকে উপসর্গ ছাড়াই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে সংক্রমণ বাড়াচ্ছেন। করোনার এ ঢেউয়ে রোগীদের শ্বাসকষ্ট কম দেখা যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে গত বছরের নভেম্বরে ১৫৭ ও ডিসেম্বরে ২২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। জানুয়ারির প্রথম ১৭ দিনে ৩ হাজার ৮৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ১৭ জানুয়ারি ৭৪২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৫৫০। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৯। ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ জানুয়ারি যথাক্রমে ১৬, ২৩, ৩৫, ৫৩, ৮২, ৭৬ ও ১০৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এভাবেই বাড়তে থাকে সংক্রমণ।
চিকিৎসকরা বলছেন, যারা ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্টের সমস্যাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত, করোনা নিয়ে তাদেরই হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। যারা করোনার দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন, তারা করোনা আক্রান্ত হলেও শারীরিকভাবে খারাপের দিকে খুব বেশি যাচ্ছে না। সংক্রমণ কমাতে জনসমাগম কমিয়ে আনা ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালনের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আফতাবুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানকার করোনা ইউনিটে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দুই সপ্তাহ আগে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ১২। আর আজ সকাল ৮টায় ভর্তি আছেন ৬৭ জন। রোববার সকাল আটটা থেকে সোমবার সকাল আটটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেলে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ছয়জন।
তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের আগে থেকেই হার্ট, অ্যাজমা, কিডনিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুসংখ্যাও বেশি। যারা আগে থেকেই বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন তারাই মারা যাচ্ছেন। তরুণ বয়সী কেউ মারা যাচ্ছে না। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যাও অনেক কম।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের উপসর্গের ধরন কেমন— জানতে চাইলে এ চিকিৎসক বলেন, আক্রান্তদের জ্বর, মাথাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট থাকে। তারপর ধীরে ধীরে অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। করোনা রোগীর জীবন বাঁচাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও করোনা ইউনিটের ফোকাল পার্সন ডা. মামুনুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা ওয়ার্ডে আজ নয়জন ভর্তি আছেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে করোনা রোগী একবারেই ছিলই না বলা যায়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে জ্বর, শরীরব্যথা, মাথাব্যথা, কাশিসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। তবে আক্রান্তদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট কম দেখা যাচ্ছে। অক্সিজেন লেভেল তেমন ফল (নিচে নামা) করছে না। আগে যেমন অধিকাংশ রোগীর শ্বাসকষ্ট ছিল, এবার তেমনটা নেই। বমি বা ডায়রিয়াও তেমন দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ মানুষ তো করোনার টিকা নিয়েছে। যার কারণে প্রতিক্রিয়া কম হচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, তারা টিকা নেননি। এবার আক্রান্তদের মধ্যে তীব্রতা কম দেখা যাচ্ছে।
করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ির কারণ হিসেবে এ চিকিৎসক বলেন, করোনা হচ্ছে বায়ুবাহিত রোগ। মানুষের সমাগম বিভিন্ন স্থানে যত বেশি হবে, করোনা তত বেশি ছড়াবে। শীতকালে পিকনিক পার্টি, সভা-সমাবেশ, ভ্রমণ অধিক হারে হয়েছিল; এ কারণে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। জনসমাগমসহ মানুষের জটলা কমিয়ে আনতে হবে। মানুষকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. নুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৭-৮ দিন ধরে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে ৩৫ জন। ডিসেম্বর-নভেম্বরে হাসপাতালটিতে করোনা রোগী ভর্তি থাকত ৮ থেকে ১০ জন। জানুয়ারির প্রথম থেকে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রামে জেনারেল হাসপাতালে আজ (সোমবার) ভর্তি আছেন ১৯ জন। যেভাবে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, সে তুলনায় রোগী ভর্তির সংখ্যা কম। রোগী বাড়লেও যাতে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় কোনো সমস্যা যাতে না হয়, সে প্রস্তুতি আমাদের আছে। এর আগেও আমরা করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। এবারও আক্রান্তদের সেবা দিতে কোনো সমস্যা হবে না। করোনার পাশাপাশি যাদের অন্য রোগ আছে, তারাই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকেই কোনো উপসর্গ ছাড়াই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। যে কারণে তারা মুক্তভাবে চলাফেরা করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। অনেকের হালকা জ্বর, কাশি ও গলাব্যথা থাকে। তবে অক্সিজেন কমে শ্বাসকষ্ট হওয়ার মতো লক্ষ্মণ ছাড়াও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। আগে যারা আক্রান্ত হননি, এবার তারাও আক্রান্ত হতে পারেন। মানুষের করোনা পরীক্ষা করানোর প্রবণতা কম। মানুষের আগে যে ভয় ছিল, তা কমে গেছে। সাত-আট দিন পর এমনিতেই মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছে। সংক্রমণ হার বাড়লেও ভয়ের কোনো কারণ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে।
তিনি বলেন, করোনা আক্রান্তদের মধ্যে যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের সিভিয়ারিটি কম। যারা নেননি তাদের ক্ষেত্রেও কমে গেছে। কারণ করোনার নতুন ধরনটি মাইল্ড মিউটেশন। বলা যায় করোনাভাইরাসের শেষ ধাপ অনেকটা। শেষ ধাপ বলার কারণ হচ্ছে, ইতোমধ্যে পৃথিবীতে প্রায় অর্ধেক মানুষ টিকা নিয়েছেন। অনেকে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। বাকি যারা আক্রান্ত হননি, টিকাও নেননি, তাদের নতুন ধরন ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে হার্ড ইমিউনিটি বাড়বে। যে কারণে আমরা বলছি ২০২২ সাল হবে করোনাভাইরাসের শেষ বছর।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংক্রমণ কমাতে জনসচেতনতার ওপর জোর দিতে হবে। জনসমাগম অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। জনসমাগম অর্ধেকে আনার বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। বিষয়টি অচিরেই চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কম। শিল্প কারখানা ও পর্যটনের যোগাযোগ হওয়ার কারণে মানুষের সমাগম বেশি চট্টগ্রামে। জনসমাগম কমিয়ে আনা ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে জনগণ এগিয়ে না এলে করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনা কষ্টকর হবে। তাই জনসমাগম অর্ধেক করতে ও স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দিচ্ছি।
চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫ হাজার ৭১৯ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে নগরের বাসিন্দা ৭৬ হাজার ৭৯১ জন। বাকি ২৮ হাজার ৯২৮ জন বিভিন্ন উপজেলার। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৭২৮ জন নগরের। আর বিভিন্ন উপজেলায় মৃত্যু হয়েছে ৬১০ জনের। ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ৯ এপ্রিল ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
কেএম/আরএইচ