যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রীকে মানসিক রোগী প্রমাণের চেষ্টার অভিযোগ
রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তিন সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ ওই শিক্ষার্থীকে মানসিক রোগী প্রমাণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
ওই শিক্ষার্থীর দাবি, তিনি পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মধ্যে থাকা হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের শিক্ষক ডা. ফারজানা রবিন তাকে ‘মানসিক ডাক্তারের নিকট যায় কি-না’, ‘পাওয়ারফুল বা মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ খান কি-না’ এ ধরনের প্রশ্ন করেন। এতে করে তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ যৌন হয়রানির শিকার ওই ছাত্রীর।
বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) রাতে ঢাকা পোস্টকে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনায় গঠন করা তদন্ত কমিটিতে পাঁচজন সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন মহিলা অধিদফতরের সদস্য আর তিনজন আমাদের কলেজের শিক্ষক।’
হয়রানির শিকার শিক্ষার্থী বলেন, ‘যেখানে অভিযুক্ত শিক্ষক পুলিশের নিকট অভিযোগ স্বীকার করেছেন, সেখানে তদন্ত কমিটিতে থাকা আমার কলেজের শিক্ষকদের প্রশ্ন শুনে মনে হয়েছে, তারা আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণের চেষ্টা করছেন। তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ন্যায়বিচার আমি পাব না।
তিনি বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ম্যাজিস্ট্রেট ও মহিলা অধিদফতরের সদস্য চলে যাওয়ার পর আমাদের কলেজের বাকি তিন সদস্যের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। তখন একজন শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করেন, স্যারের সঙ্গে এত রাতে কেন কথা হয়েছে, আমি কোনো মানসিক ডাক্তার দেখাই কি-না, আমি কোনো পাওয়ারফুল বা মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ খাই কি-না...। তার মানে হলো- তারা আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণের চেষ্টা করছেন।’
একজন শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করেন, স্যারের সঙ্গে এত রাতে কেন কথা হয়েছে, আমি কোনো মানসিক ডাক্তার দেখাই কি-না, আমি কোনো পাওয়ারফুল বা মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ খাই কি-না...। তার মানে হলো- তারা আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণের চেষ্টা করছেন।’
‘ছোটবেলা থেকেই আমার রাত জেগে পড়াশোনার অভ্যাস। বিশেষ করে করোনার ওই সময়টাতে যেহেতু বাইরে বের হওয়া হতো না, তাই দিনের বেলায় ঘুমটা বেশি হতো, পরে রাত জেগে পড়াশোনা করতাম। আর স্যারকে কখনোই আমি নিজে থেকে বেশি রাতে কোনো দিন ফোন দেইনি, প্রয়োজন হলে সন্ধ্যার দিকেই ফোন দিতাম, কিন্তু তিনি মধ্যরাতে আমাকে কল/মেসেজ দিতেন। তখনই প্রয়োজনের বিষয়ে কথা হতো। এরপর তিনি আমাকে নানা সময়ে কুপ্রস্তাব দিতে থাকেন’, বলেন তিনি।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, তদন্ত কমিটিতে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট ও মহিলা অধিদফতরের সদস্যদের নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার বিশ্বাস তারা বিষয়টার সুষ্ঠু তদন্ত করবেন। কিন্তু কমিটিতে সংখ্যাগুরু সদস্য আমাদের কলেজের শিক্ষক। ঘটনার শুরু থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষের দ্বারা আমি যে ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্মুখীন হয়েছি, আমি মনে করছি তাদের থেকে সঠিক ও সত্য তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া সম্ভব নয়। তদন্ত কমিটিতে থাকা আমি আমার কলেজের শিক্ষকদের ওপর অনাস্থা প্রদান করছি।’
এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির সদস্য ডা. ফারজানা রবিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছু বলতে পারছি না।’
মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণের চেষ্টার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি অবাক হয়ে ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদকের কাছে ‘কে প্রশ্ন করেছে’ জানতে চান। এরপর কমিটির বাকি দুজনকে রেখে কলেজের শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে ওই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘তদন্ত কমিটি হাইকোর্ট নির্দেশিত কমিটি। এই কমিটিতে যে শুধু আমাদের কলেজের শিক্ষকরা আছেন তা নয়, মহিলা অধিদফতরের ম্যাজিস্ট্রেটরাও আছেন। প্রশ্ন সবাই মিলেই করা হয়েছে। আর বিষয়টা নিয়ে কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কিছুই বলতে পারছি না।’
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. দৌলতুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সর্বশেষ আমি যতটুকু শুনেছি, গঠিত তদন্ত কমিটি ভিকটিমসহ অনেকেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এখন অভিযুক্তের সাক্ষাৎকারের জন্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এখন জেলার যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে আবার জজ কোর্টে আবেদন করে অভিযুক্তের সাক্ষাৎকার শেষ করেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।’
তদন্ত কমিটির তিন শিক্ষকের বিষয়ে আপত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কমিটি আমরা কেউই করিনি, এটা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মতেই হয়েছে। এই কমিটির নিয়মই হলো তিনজন থাকবে কলেজ থেকে, আর বাইরের থাকবে দুজন। এ অবস্থায় যদি আপত্তি তোলা হয়, এটা তো ঠিক হলো না। আর তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়া পর্যন্ত এটা নিয়ে আমারও কিছু বলা ঠিক হবে না হয়তো।’
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. দৌলতুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সর্বশেষ আমি যতটুকু শুনেছি, গঠিত তদন্ত কমিটি ভিকটিমসহ অনেকেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এখন অভিযুক্তের সাক্ষাৎকারের জন্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এখন জেলার যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে আবার জজ কোর্টে আবেদন করে অভিযুক্তের সাক্ষাৎকার শেষ করেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।’
প্রসঙ্গত, গেল বছরের ২৯ ডিসেম্বর হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করে র্যাব। এর আগে গত ২২ ডিসেম্বর ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন কলেজের শেষবর্ষের এক শিক্ষার্থী।
জিডিতে শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, পরীক্ষায় পাস না করিয়ে একই শিক্ষাবর্ষে অনেক বছর রাখার হুমকি দিয়ে শিক্ষক সালাউদ্দিন তাকে মেসেঞ্জারে খারাপ প্রস্তাব দেন। প্রাইভেট পড়ার জন্য তাকে বাসায় যেতে বলেন। কিন্তু বাসায় যেতে শিক্ষার্থী রাজি হননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন সালাউদ্দিন।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে তাকে এই হয়রানি করে আসছেন ডা. সালাউদ্দিন। এতে তার পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে ওই শিক্ষার্থী জিডিতে অভিযোগ করেন। এরপর গত ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর রমনা থানায় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।
টিআই/ওএফ