ভোগান্তির শুরু বিমানবন্দরের হেলথ ডেস্কে
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-২৫ ফ্লাইটে গত সোমবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে কাতারের দোহা থেকে ঢাকায় আসেন প্রবাসী জমীর উদ্দিন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিদেশফেরত যাত্রীদের ফ্লাইট থেকে নেমেই প্রথমে অধিদফতরের হেলথ ডেস্কে যান যাত্রীরা। তবে সোমবার রাতে ওই ডেস্কে যেতে যাত্রীদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। হেলথ ডেস্কে এতোই ভিড় ছিল যে যাত্রীরা বিমানবন্দরে টার্মিনালের ভবনে ঢুকতে পারেননি। হেলথ ডেস্কের লাইন ধরেছেন গেটের বাইরে থেকেই।
জমীর উদ্দিন বলেন, রাতে একসঙ্গে কয়েকটি ফ্লাইট অবতরণের ফলে বিমানবন্দরে অনেক যাত্রীর ভিড় ছিল। ফলে আমাদের টার্মিনাল ভবনের বাইরে থেকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। একসঙ্গে প্রায় ৬০০-৭০০ মানুষের ভিড়। ডেস্কের ৭-৮টি কাউন্টারেই মাছের বাজারের মতো ভিড়, হইহুল্লোড় আর ধাক্কাধাক্কি। সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি কোনো কিছুরই বালাই ছিল না। বরং সেখান থেকেই করোনা ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সাধারণত স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিচালিত ডেস্কে হেলথ ডিক্লারেশন ফরম এবং বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের আনা করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট যাচাই-বাছাই করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে সেই ফরমে সিল দিয়ে একটি অংশ রেখে দেওয়া হয়। এই সিল ছাড়া ইমিগ্রেশন করা যায় না। তাই বাধ্যতামূলকভাবে দাঁড়াতে হয় এই লাইনে।
সরেজমিন বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, হেলথ ডেস্কের ৮টি লাইনে নারী ও শিশুসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক দাঁড়ানো। কারো হাতে ছোট লাগেজ, কেউ মাথায় ব্যাগ নিয়েই দাঁড়িয়েছেন লাইনে। বিমানবন্দরে এর আগে এমন চিত্র কখনোই দেখা যায়নি। দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণ ক্লান্তির সঙ্গে বিমানবন্দরে অপেক্ষা ভোগান্তি বাড়িয়েছে প্রবাসীদের।
একই ফ্লাইটের যাত্রী হামিদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বাংলাদেশিরা এধরনের ভোগান্তি পেতে পেতে অভ্যস্ত। তবে আমাদের সঙ্গে আসা বেশ কয়েকজন বিদেশি ব্যবসায়ী এধরনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে চরম বিরক্তি দেখিয়েছেন। দেশে ঢুকে বিদেশি কেউ যখন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেস্কে এধরনের চিত্র দেখে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, বর্তমানে আমাদের ৮টি ডেস্ক রয়েছে। আমাদের আরও ডেস্ক রেডি আছে, তবে বিমানবন্দরের আগমনী টার্মিনালে এগুলো বসানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তিনি বলেন, দেশে আসা সব যাত্রী একটি গেট দিয়েই প্রবেশ করে, রাস্তা তো একটাই। সেই জায়গায় ৮টির বেশি আর ডেস্ক বসানোর সুযোগ নেই।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দিনে ৮ ঘণ্টা করে রানওয়ে বন্ধ থাকে। তবে ফ্লাইটের সংখ্যা কমেনি। ২৪ ঘণ্টার ফ্লাইট এখন ১৬ ঘণ্টায় নামে। মঙ্গলবারও ৪৮টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নেমেছে ঢাকায়। একসঙ্গে এতো ফ্লাইটের যাত্রী আসায় অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাচ্ছে আমাদের।
শুধু হেলথ ডেস্ক নয়, বর্তমানে দেশে ফেরা ও দেশ ছেড়ে যাওয়া যাত্রীরা পদে পদে হয়রানি-ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে শীতকালীন শিডিউল ও তৃতীয় টার্মিনালের সংস্কার কাজের জন্য ২৪ ঘণ্টার ফ্লাইটসূচি পরিবর্তিত হয়ে ১৬ ঘণ্টায় এসেছে। ছয় মাস জন্য রাতে ৮ ঘণ্টা (রাত ১২টা-সকাল ৮টা) ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। আগে যেখানে বিমানবন্দরে ঘণ্টায় ৬টি ফ্লাইট অবতরণ করত, বর্তমানে সেই সংখ্যা ৯ থেকে ১২টিতে ওঠানামা করছে। ফলে বিমানবন্দরে যাত্রীর চাপ বেড়ে গেছে।
অতিরিক্ত যাত্রীর চাপের কারণে বিমানবন্দরের চেক-ইন কাউন্টার, ইমিগ্রেশন, বোর্ডিং, লাগেজ বেল্টসহ প্রতিটি কাউন্টারে লম্বা লাইন। প্রতিদিনই মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি রুটের ফ্লাইট বিলম্বে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে।
সার্বিক অব্যবস্থাপনার বিষয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, ‘রাতে রানওয়ে ৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকায় দিনে চাপ পড়ে যাচ্ছে। রানওয়ে বন্ধ হওয়ার শুরুর দিনগুলোতে ফ্লাইট সংখ্যা ও যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছিল। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভালো হতে শুরু করেছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি।'
ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দীর্ঘ অপেক্ষা
সোমবার সৌদি আরবের দাম্মাম থেকে ঢাকায় আসা জামালপুরের প্রবাসী মোহাব্বত জান মুনসী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ফ্লাইটে প্রায় ৩০০ জন একসঙ্গে ছিলাম। বিমানবন্দরে ঢুকে দেখি অন্য দুটি ফ্লাইটের আরও ৩ শতাধিক যাত্রী। আগমনী যাত্রীদের জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশের ৭-৮টি কাউন্টার ছিল। প্রতিটি কাউন্টারে ২ জন করে অফিসার থাকার কথা থাকলেও বেশ কয়েকটি কাউন্টারে অফিসার ছিল না। দু'একজন আবার একজনের ইমিগ্রেশন শেষ করে সিট থেকে উঠে যায়। ২/১ মিনিট পর আবার আসে। আমি গতবার সৌদি যাওয়ার সময়ও দেখেছিলাম ইমিগ্রেশন পুলিশ শুধু আমাদের দেরি করায়।
তিনি বলেন, তারা চাইলেই হাতে পাসপোর্ট নিয়ে ২-১ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দিতে পারে। বিদেশে তাই হয়। তবে আমাদের দেশে ১০-১২ মিনিট বা তারও বেশি সময় নেয়।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে মালদ্বীপগামী যাত্রী আবদুর রহমান লালু ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোববার সকালে আমার ফ্লাইট ছিল। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ১০-১২ জনের পেছনে ছিলাম আমি। আমার ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে ৫০ মিনিট লেগেছে। কিছুদিন আগে তুরস্কে ঘুরতে যাওয়ার সময়ও একইভাবে বিলম্ব হয় ইমিগ্রেশনে। কাউন্টার থাকলেও এখানে পুলিশ থাকে না।
এবিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, আমি ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ইমিগ্রেশন পুলিশের বিষয়ে কথা বলেছি। আমি বলেছি ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাতে ২৪ ঘণ্টা অফিসার থাকে, কোনো কাউন্টার যাতে ফাঁকা না থাকে। যাত্রীরা যাতে অল্প সময়ে ইমিগ্রেশন করে গন্তব্যে যেতে পারেন, এবিষয়ে আমি ইমিগ্রেশন পুলিশের ডিআইজি এবং এএসপির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা পর্যাপ্ত সেবার আশ্বাস দিয়েছেন।
বিমানবন্দরে ঢুকতে ভোগান্তি
বাংলাদেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন শনাক্তের পর থেকেই বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের প্রবেশ কিছুটা সীমিত করা হয়েছে। বর্তমানে বিমানবন্দরের প্রধান ফটক থেকে অনেক যাত্রীর সঙ্গেই পরিবারের অতিরিক্ত সদস্য থাকলে তাদের আটকে দেয় এপিবিএন। গাড়ি থেকে নামিয়ে শুধুমাত্র গাড়ি ও যাত্রীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় বিমানবন্দরে।
এমিরেটস এয়ারওয়েজের দুবাইগামী যাত্রী সৈয়দ রাসেল রানা বলেন, গত রোববার বহির্গমন টার্মিনালে প্রবেশের সময় এয়ারপোর্ট এপিবিএনের সদস্যরা আমার স্ত্রী ও দুই বোনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেন। আমি চালকের সঙ্গে বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনে যাই। গাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না বলে বাইরে থেকে তারা বার বার আমাকে ফোন দেয়। নতুন নতুন এসব নিয়ম-কানুন আমরা জানতাম না। এ ধরনের আরও অনেক ভোগান্তি রয়েছে যেগুলো আমরা পদে পদে টের পাচ্ছি। প্রবাসীদের ভোগান্তি লাগবে বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষকে বিবেচনার অনুরোধ জানান তারা।
এআর/জেডএস