শরীরের কালো দাগ নিয়ে স্বামী বলছেন, ‘সামান্য ধস্তাধস্তি হয়েছিল’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নৃত্যকলা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ইলমা চৌধুরী মেঘলার (২৪) মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করেছে তার পরিবার। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে তাকে। মামলাটি দায়ের করেন ইলমার বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী।
এ ঘটনায় মঙ্গলবারই আটক করা হয় ইলমার স্বামী ইফতেখার আবেদীনকে। আটকের পরপরই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত বারবার একই কথা বলছিলেন ইফতেখার। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দাবি করেন, ‘ইলমা আবেগী ছিল, সে আত্মহত্যা করেছে।’
পুলিশের গুলশান বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সন্ধ্যার পর ইলমার মৃত্যুর খবর জানার পর থেকেই একে হত্যা বলে দাবি করে পরিবার। এরপর রাতে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ইফতেখারকে। রাতে তিনি একই কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, ‘ইলমা আত্মহত্যা করেছে।’
পুলিশ জানায়, ইলমার শরীরের দাগ নিয়ে স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বলেন, ‘গত (সোমবার) রাতে আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় একটু ধস্তাধস্তি হয়েছিল। এটি তেমন কোনো বিষয় নয়। ধস্তাধস্তিতে সে ব্যথা পেতে পারে। তাই শরীরে কালো দাগ হয়েছে।’
হত্যা নাকি আত্মহত্যা
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আজম মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইলমার বাবা গতকাল রাতে বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা হওয়ার আগে থেকেই আমরা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তাই আমরা তাকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড আবেদন করেছি।
এদিকে ইলমার বনানীর বাসা থেকে ইতোমধ্যে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। আলামত সংগ্রহ করেছে ফরেনসিক টিম। হত্যা নাকি আত্মহত্যা সে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরিষ্কার হবে বলে জানান ওসি নুরে আজম।
ইলমার বাবার মামলায় স্বামী ছাড়াও তার শ্বশুর ও শাশুড়িকে আসামি করা হয়েছে। তারা বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
ইলমার ওপর নজরদারি করত স্বামী-শ্বশুরবাড়ির লোকজন
নিহত ইলমার সহপাঠী ঢাবি শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, ইলমার বিয়ের বেশিদিন হয়নি। বিয়ের পর থেকেই ক্লাসে অনিয়মিত হয়ে পড়ে সে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ওপর নজরদারি চালাত বলে মনে হয়েছে। কয়েক দিন আগেই তার স্বামী কানাডা থেকে ফিরেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইলমার আরেক সহপাঠী বলেন, বিয়ের পর যতদিন ইলমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, প্রতিবারই শ্বশুরবাড়ির কেউ না কেউ তার সঙ্গে ক্যাম্পাসে ছিল। তার স্বামীও প্রায়ই ভিডিও কলে নানা প্রশ্ন করত। আমরা পাশে থেকে শুনতাম। ইলমা অনেকসময় বিব্রত বোধ করত। বিয়ের পর ইলমার মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। সে অনেক সহপাঠীর সঙ্গেই মিশত না। আমাদের ধারণা, বিয়ের পর তাকে ব্যাপক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে রাখা হতো।
পরিবার বলছে, ‘আত্মহত্যা অসম্ভব’
ইলমার মৃত্যুর সংবাদ শুনে ভেঙে পড়েন মা সিমথি চৌধুরী। ইউনাইটেড হাসপাতালে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না। আমি তাকে ভালো করে চিনি। এটি কোনোভাবেই সম্ভব না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার হত্যাকারীকে ধরুন। আমি মেয়ের হত্যার বিচার চাই।’
শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে ইলমার মৃত্যুর খবর প্রথমে জানানো হয় তার খালু ইকবালকে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তারা আমাকে ফোন দিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে যেতে বলে। আমি ওর শাশুড়ির কল পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি ইলমা মারা গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইলমার শরীরে আমরা অনেক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। গলায়ও আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। ইলমা আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা নিশ্চিত ইলমাকে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেরে ফেলেছে।’
নিয়মিত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন
ইলমার মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার এজাহারে মূলত ‘শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ইলমার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তার স্বামী কানাডায় ছিলেন। বিয়ের পর ইলমা বনানীতে তার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেন। তার স্বামী গত সপ্তাহে কানাডা থেকে দেশে ফেরেন।
বিয়ের পর থেকেই ইলমার ওপর শ্বশুর ও শাশুড়ি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিতেন না। ইলমার কথা শুনে তার পরিবারের লোকজন ধারণা করেন যে, তার ওপর নির্যাতন হতো। তবে ইলমা মুখ ফুটে পরিবারকে কিছু জানাননি। আঘাতের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শরীরে আঘাত ও মারধরের অসংখ্য দাগ রয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর বনানীতে স্বামীর বাসায় মারা যান ইলমা। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনই পুলিশকে কল দিয়ে আত্মহত্যার কথা জানান। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ইলমাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যায়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এআর/আরএইচ