ধর্ষক স্বামীর হাতেই খুন হন শারমিন
বরিশালের লঞ্চের কেবিন থেকে উদ্ধার হওয়া শারমিন আক্তারের হত্যাকারীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। র্যাব জানায়, শারমিনের স্বামীই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আজ (সোমবার) সকালে শারমিনের ঘাতক স্বামী মো. মাসুদ হাওলাদারকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর সকালে ঢাকা-বরিশাল পথের এমভি কুয়াকাটা-২ লঞ্চের কেবিনে এক অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ পাওয়া যায়। এই ঘটনায় বরিশাল কোতোয়ালী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন শারমিনের বাবা। প্রাথমিক তদন্তের পর মাসুদকে গ্রেফতার করে র্যাব।
আজ র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতারকৃত মাসুদ ২০১২ সাল থেকে আশুলিয়ার একটি কোম্পানিতে পিকআপের হেলপার হিসেবে কর্মরত। ভিকটিম শারমিন ১২ বছর ধরে ঢাকার তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়ায় তার চাচার বাসায় থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। ২০১৯ সালের শুরুতে তার সাথে মাসুদের পরিচয় হয়। শারমিন বিমানবন্দর থানায় মাসুদের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণ মামলাও করেছিলেন। পরবর্তীতে মামলার নিষ্পত্তির জন্য উভয় পরিবারের সম্মতিক্রমে ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর শারমিনের চাচার বাসায় তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা একত্রে বসবাস না করে থেকে নিজ নিজ কর্মস্থলে বসবাস করেন।
মঈন বলেন, গ্রেফতারকৃত মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি শারমিনকে বিয়ে করলেও তার সাথে সংসার করার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু শারমিনকে ডিভোর্স দিতে চাইলেও দেনমোহর বাবদ ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করার ক্ষমতা তার নেই। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। ফলে ঘটনার ১৫-২০ দিন আগে শারমিনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ঘটনার ৫ দিন আগে শারমিন সর্দি এবং কাঁশিতে আক্রান্ত হন। মাসুদ শারমিনের এই অসুস্থতার সুযোগে তাকে কাশির সিরাপের সাথে বিষপান করানোর পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাসুদ চারদিন আগে আশুলিয়া বাজার থেকে এক বোতল চেতনানাশক ওষুধ কেনেন। তারপর ঘাতক মাসুদ নিজে বরিশালে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাগজ জমা দিতে যাবে বলে শারমিনকে ঘুরতে নিয়ে যেতে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকেন।
গত ৮ তারিখ রাতে শারমিন সামনে সাপ্তাহিক ছুটির কথা চিন্তা করে ৯ ডিসেম্বর মাসুদের সাথে বরিশালে রওনা করার জন্য রাজি হয়ে যান। ৯ তারিখ দুপুরে মাসুদ এবং শারমিন মিরপুর-১ থেকে বরিশাল যাওয়ার উদ্দেশে বাসযোগে সদরঘাট যাত্রা করেন। আশুলিয়া বাজার হতে ৫০ টাকা দিয়ে কাশির সিরাপ কেনেন এবং পূর্বে ক্রয়কৃত বিষ ও চেতনানাশকের কিছু অংশ কাশির সিরাপের বোতলে ভরে নেন।
মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, হত্যার সময় যাতে শারমিনের আর্তচিৎকারে আশপাশের কেউ কোনো কিছু শুনতে না পায় সেজন্য তিনি পরিকল্পিতভাবেই বরিশালগামী এমভি কুয়াকাটা-২ লঞ্চের লস্কর কেবিন ভাড়া নেন। লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের পাশেই লস্কর কেবিন অবস্থিত। ফলে কেবিনের ভেতরের কোনো শব্দ বাইরে থেকে শুনতে পারা অসম্ভব। ৯ ডিসেম্বর রাতে আনুমানিক ৯টায় লঞ্চটি বরিশালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরু করার পর ঘাতক মাসুদ তার সাথে থাকা বিষযুক্ত কাশির সিরাপ শারমিনকে খাওয়ান। বিষ খাওয়ার পর শারমিন ৩/৪ বার বমি করে অসুস্থ এবং দুর্বল হয়ে যান। এরপর জোরপূর্বক চেপে ধরে অবশিষ্ট বিষ শারমিনের মুখে ঢেলে দেন। অসহায় শারমিন তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় তার পা ছুড়তে থাকেন। কিছুক্ষণ পর শারমিন সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে গেলে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে যান।
রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে ঘাতক মাসুদ কেবিনের সামনে এসে দেখতে পান, শারমিন কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে বিষের বোতলটি কেবিনের মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। ঘাতক মাসুদ তখন পানি দিয়ে কেবিনের দরজার সামনে পড়ে থাকা বিষ পরিষ্কার করে পুনরায় কেবিনে প্রবেশ করেন। মাসুদের দেওয়া তথ্যমতে যখন তিনি যখন কেবিনে প্রবেশ করেন তখনও শারমিনের শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান ছিল। ঘাতক মাসুদ তখন তার কাঁধব্যাগ থেকে শার্ট বের করে নির্মমভাবে শারমিনের শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। লঞ্চ যখন চরমোনাই ঘাটে পৌঁছায়, তখন মাসুদ কেবিন থেকে বের হয়ে লঞ্চের দরজায় যান। লঞ্চ বরিশাল শহরের ঘাটে এসে পৌঁছালে তিনি স্বাভাবিকভাবে লঞ্চ থেকে বের হয়ে সড়কপথে নিজ বাড়িতে চলে যান।
এআর/এইচকে