মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ‘উদ্বিগ্ন’ না হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তারা বলছেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় ঢাকা ও ওয়াশিংটনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এ ইস্যুতে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের প্রভাব এবং হাঠাৎ কেন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা— এসব বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত আলাপে এমন অভিমত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় দিয়ে থাকে। এটা নতুন কিছু না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও এক সময় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছিল। যখন সে প্রধানমন্ত্রী হলো সেটা তুলে নিল। সে বড় বন্ধু হয়ে গেল। এগুলো হলো রাজনীতির একটি অংশ। এটা হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। হতে পারে এখান থেকে তথ্য গেছে বা যারা তাদের পছন্দের লোক তারা তথ্য দিয়েছে। ঠিক কোন কারণে এটা করেছে সেটা বোঝা মুশকিল। তবে এটা ডমোস্টিক পলিটিকসের ব্যাপার। যেহেতু আফগানিস্তান থেকে রীতিমত পালিয়েছে, সেজন্য পৃথিবীকে কিছু একটা দেখাতে হবে। কিছু করেতো দেখাতে হবে, তাই গণতন্ত্র বা মানবাধিকার এগুলো সামনে নিয়ে আসছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরও কিন্তু তা করেছে। যখন পালিয়ে গেল তখনও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে চিৎকার করল। চীনের পেছনে লেগেছে। এটা বোঝাই যায়, এটা তাদের ডমোস্টিক পলিটিকসের ব্যাপার। কোনো একটা রাজনীতি আছে। পৃথিবীকে দেখাল মানবাধিকার লঙ্ঘন।’
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় এ জন্য তাদের পুলিশকে আগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। প্রতি বছর তাদের ১ হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়, পুলিশের দ্বারাই হয়। এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমাদের উপমহাদেশের অনেক দেশেই হয়। আমাদের চেয়ে প্রতিবেশি দেশগুলো আরও বেশি হয়। তাদের তো ডাকার সাহস নেই। এটা সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। তবে মনে রাখতে হবে যে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া দরকার। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলে, অথচ তাদের নিজেদের দেশেই গণতন্ত্র নেই।’
এ নিষেধাজ্ঞা ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে এ বিশ্লেষক বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশ আমেরিকার সম্পর্ক নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। জাতিসংঘে বা বিভিন্ন দেশে আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও কোনো প্রভাব পড়বে না।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতর।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ রয়েছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। একই সঙ্গে তিনি দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন।
এ ছাড়া র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যখন কোনো একটি বিদেশি সংবাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে তখন নিঃসন্দেহ এটি রাজনৈতিক। এটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তথ্যভিত্তিক হয় বলে আমি মনে করি না। পদ্মা সেতুর নিয়ে যে দুর্নীতির কথা বলল সেটা তখন টিকল না। বাংলাদেশের পলিটিকাল অপজিশনরা যারা প্রতিনিয়ত এ বিষয়টি নিয়ে বলেন, তারা তাদের অনুসারীরা এনজিওদের মারফ তথ্য নিয়ে ইমেইল করেন। এটাকে আমরা বলি কান কথা। কান কথা শুনে সেটির ওপর যদি বড় বড় গল্প বানিয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তাহলে সেটি সঠিক হবে না। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে বাংলাদেশকে বর্তমানে চীন বিরোধী যে প্রক্রিয়া আছে সেখানে ব্যবহার করতে চাওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা হয়নি। না হওয়ার ফলে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার। এটা নিয়ে চিন্তা বা উদ্বেগের কিছু দেখছি না।’
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে এরা শীর্ষ কর্মকর্তা। তারা নিজেরা মাঠে কোনো অপরাধ দমন করতে যান না, পরিচালনা করেন। সেক্ষেত্রে এমন কোনো তথ্য এখন অবদি আমরা পাইনি, তারা সম্মতি দিয়েছেন গুলি করে কাউকে মেরে ফেল। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মানবিক ভূমিকা পালন করেছে। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক থাকে তাহলে দেশটিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জায়গা হয়েছে কেন? তারপরে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশের যত জঙ্গি আছে তাদেরও জায়গা হয়েছে। যখন বাংলাদেশ জঙ্গি দমনে তৎপর তখনও র্যাবের বিরুদ্ধে কথা উঠেছে। যে র্যাব জঙ্গি দমনে বাংলাদেশে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এটি রাজনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ইস্যু তৈরি করা হয়েছে।’
আবদুর রশীদ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পরাশক্তি যখন অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশের কাজ হবে তাদের কাছে দলিলপত্র চাওয়া। যদি এটার প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের প্রচলিত আইনে এটার বিচার করা।’
এনআই/এসএম