সড়কের পাশেই মৃত্যুফাঁদ, পা ফসকালেই সর্বনাশ
গত সাড়ে সাড়ে ৫ মাসে চট্টগ্রাম নগরীতে ‘অরক্ষিত’ খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫ জনের, নিখোঁজ রয়েছেন একজন। তবু দুর্ঘটনা থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে খোলা খাল-নালায় মৃত্যুঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
গত ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর এলাকায় হাঁটার সময় পা পিছলে নালায় পড়ে যান সবজি ব্যবসায়ী ছালেহ আহমদ। এরপর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। এখনও তার কোনো সন্ধান মেলেনি। এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার। তারপর গত ৩০ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়ী স্টেডিয়াম সংলগ্ন ফুটপাত ধরে হাঁটার সময় নালায় পড়ে পা ভেঙে যায় কলেজছাত্র ইয়াসিন আরাফাতের।
সর্বশেষ সোমবার (৬ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর এলাকায় খালে খেলনা তুলতে গিয়ে নিহত হয় কামাল হোসেন নামের এক শিশু। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে খালে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও নালায় স্ল্যাব বসানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে নগরীর খাল-নালায় স্ল্যাব ও ব্যারিয়ার দেওয়ার ব্যাপারে আশার বাণী শুনিয়েছে নগর সংশ্লিষ্ট দুই সংস্থা- চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
চসিকের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীতে খাল-নালা রয়েছে এক হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় রয়েছে ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এসব খাল ও নালায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও এসব স্থানে নিরাপদ করার কাজ চলছে ঢিমেতালে।
এ প্রসঙ্গে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমাদের যেসব নালায় কাজ চলছে না, সেখানে আমরা ইতোমধ্যে স্ল্যাব বসানোর কাজ শুরু করেছি। নালার উপর স্ল্যাব আগে যেভাবে ভাঙা ছিল, উঠানো ছিল এখন কিন্তু তেমন নেই। বেশিরভাগ ফুটপাতে আমরা ইতোমধ্যে স্ল্যাব দিয়ে দিয়েছি। আমরা একটা টার্গেট নিয়েছি জানুয়ারির মধ্যে পুরো চট্টগ্রামের নালার উপর স্ল্যাব বসাব। তবে যেগুলোতে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ চলছে সেগুলোতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের থেকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান ড. মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রামের খাল ও নালার ডিজাইন দেশের অন্য শহরের থেকে ব্যতিক্রম হবে। কারণ এখানে পাহাড় আছে। এখানে খাল-ড্রেনগুলো উন্মুক্ত রাখতে হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কারের জন্য। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। এ ধরনের চওড়া ও গভীরতা সম্পন্ন খালগুলোর পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা জরুরি। দেয়াল বা গ্রিল দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে।
তিনি বলেন, যেসব সংস্থা উন্নয়নমূলক কাজ করছে তাদের কাজ করার সময় জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে। কনস্ট্রাকশনের কাজ চলার সময় যে ঠিকাদার কাজ করবে, তাদেরই কাজ চলা অবস্থায় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার সেই ঠিকাদার বা যারা কাজ করছে তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে কি না তা খোঁজ নেওয়া তদারকি সংস্থার দায়িত্ব। আমরা আশা করছি যেসব সংস্থা উন্নয়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে।
চট্টগ্রাম নগরীতে খাল আছে ৫৭টি। এসব খালের দৈর্ঘ্য ১৬১ কিলোমিটার। নালা রয়েছে ৯৭২ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে যে প্রকল্প চলছে, সে প্রকল্পের অধীনে খাল আছে ৩৬টি। অন্যদিকে ৩০২ কিলোমিটার নালায় সংস্কার কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম নগরীতে খাল-নালায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই চসিক-সিডিএ একে অপরকে দোষারোপ করে। মুরাদপুর এলাকায় ছালেহ আহমদ খালে পড়ে নিখোঁজ হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি করেছিল বিভাগীয় কমিশনার। সেই তদন্ত কমিটি মুরাদপুরে নালায় পড়ে ব্যবসায়ী ছালেহ আহমেদের (৫০) নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) দায়ী করেছিল।
৩ নভেম্বর তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, মুরাদপুরে যারা কাজ করছে, তাদের গাফিলতি ছিল। জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজের জন্য সিডিএ এক বছর আগে স্ল্যাবগুলো ভেঙে ফেলে। কিন্তু নালার কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি তারা। আর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়া আগ্রাবাদে সাদিয়ার মৃত্যুর পরে সিডিএ ও চসিক একে অপরকে দায়ী করেছিল। দুর্ঘটনা ঘটনার পর মুরাদপুর ও আগ্রাবাদে সিডিএ ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর খালগুলোতে বর্তমানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলছে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের। এগুলোই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের ড্রেন আছে ১৬০০ কিলোমিটার। ছোট ড্রেন এগুলো। আমাদের নালায় পড়লে কেউ ব্যথা পাবে, কিন্তু মৃত্যুঝুঁকি তেমন নেই। আমাদের ড্রেনগুলোতে স্ল্যাব দেওয়ার কাজ চলছে। ছালেহ আহমদ মারা যাওয়ার পর থেকেই আমাদের কাজ চলছে। বড় সাইজের নালাগুলোতে আমরা স্ল্যাব ও নিরাপত্তা বেষ্টনী দিচ্ছি। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় যেগুলোতে কাজ চলছে সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমারা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। যেখানে সিডিএ কাজ করছে, সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তাদের।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ করায় ৩৬টি খাল আমাদের অধীনে আছে। আমরা তো দুই বছর ধরে কাজ করেছি। আগে তো সবগুলো খাল-নালা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এত বছর তারা কি করেছে। খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। আগে সিটি করপোরেশন কেন খালগুলোতে ও বড় নালাগুলোতে ব্যারিয়ার দেয়নি। এগুলো দেওয়া তো তাদের উচিত ছিল। সব জায়গায় তো সিটি করপোরেশনকে ব্যারিয়ার দিতে হচ্ছে না, শুধুমাত্র যেগুলো রাস্তার পাশে আছে সেগুলোতে ব্যারিয়ার দিলেই হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দায়িত্বে বর্তমানে যে ৩৬টি খাল আছে সেগুলোতে ব্যারিয়ার দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব স্থান দিয়ে মানুষ চলাচল করে, যেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোতে দ্রুত ব্যারিয়ার দেওয়ার কথা বলে দিয়েছি সেনাবাহিনীকে। আমাদের অধীনে যেসব খাল ও নালা আছে সেগুলোতে কাজ শেষ হলে সব খালে ও নালায় নিরাপত্তা ব্যারিয়ার দেওয়া হবে। এছাড়া যেসব স্থানে কাজ চলছে সেগুলোতেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি।
কেএম/এসএসএইচ