‘আমার কামালকে এনে দাও’
কত আর বয়স? বছর দশেক। রঙিন খেলনার শখ ছিল হয়ত। কিন্তু পেশায় তারা টোকাই। যেখানে ভাতের নিশ্চয়তা নেই সেখানে খেলনার বিলাসিতা মানায় না। তাই বলে শিশু মনের শখ তো উবে যায় না। তাই নালায় খেলনা দেখে নেমেছিল ছোট্ট রাকিব আর কামাল। রাকিব খেলনা তুলতে গিয়ে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছিল। কামাল সাঁতার জানে না। কিন্তু বন্ধুর জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে বসে থাকে কী করে? বন্ধুকে বাঁচাতে তাই সেও পানিতে নামে। তারপর শহর চট্টগ্রামের শত টোকাইয়ের অনেক স্বপ্নের মতো ভেসে যায় সে। এখনও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনা সোমবার বিকেলের। চোখের সামনে বন্ধুকে এভাবে হারাতে দেখে ভয়ে আর শঙ্কায় স্থবির হয়ে যায় রাকিব। দুরু দুরু বুকে কামালের বাবাকে গিয়ে জানায়। ততক্ষণে শীতের সন্ধ্যা নামছে। কামালের বাবা মোহাম্মদ আলী কাউছার দৌড়ে যান নালার পাড়ে, পাগলের মতো খোঁজেন একমাত্র ছেলেকে। তারপর হিমেল শূন্য রাত; চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের যেখানে কাউছারের বুকে সুখে ঘুমাত ছেলে কামাল, সেটি পড়ে থাকে ফাঁকা।
আজ মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে ফায়ার সার্ভিস কামালকে উদ্ধারের জন্য নগরীর দুই নম্বর গেট ও ষোলশহর রেলস্টেশনের মাঝামাঝি এলাকায় অভিযান চালায়। সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশ বড় এই নালাটি এসিল্যান্ড অফিসের কাছে। নালার ওপর কোনো স্ল্যাব নেই। সেখানে কামালের খোঁজে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে ময়লা তুলছে। পাশেই দেখা গেল কামালের বাবাকে।
খোলা আকাশের নিচে আবাস যে মোহাম্মদ আলী কাউছারের, তিনি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আর আমার ছেলে একসাথে থাকতাম ষোলশহর রেলস্টেশনে। দৈনিক কাজ করে যা পেতাম তা দিয়ে বাবা-ছেলে খেতাম। একটি খেলনার জন্য ছোট্ট ছেলেটা নালায় নেমে আর উঠতে পারেনি। সোমবার সন্ধ্যার দিকে বিষয়টি শুনতে পাই তার বন্ধু রাকিবের কাছে। এরপর ছেলেকে সারা রাত নালায় খুঁজেছি, পাইনি। দিনেও খুঁজেছি, এখনও পাইনি। আমার কামালকে কেউ এনে দাও।’
কান্নায় ভেঙে পড়েন মোহাম্মদ আলী কাউছার। স্ত্রীহীন সংসারে ছেলেই তার একমাত্র আত্মীয়। দিনমজুরের কাজ করে ছেলেকে নিয়ে প্রায় ভ্রাম্যমাণ এই জীবন কেটে যাচ্ছিল। ছেলেকে হারিয়ে এখন তার দুই চোখে কেবলই নিঃসঙ্গতা।
কামালের বন্ধু রাকিব ঢাকা পোস্টকে বলে, ‘খেলনা দেখে নালায় নেমেছিলাম। তখন আমি কিছুটা তলিয়ে গেলে কামালও নামে। আমি সাঁতার জানলেও কামাল জানতো না। তাই সে তলিয়ে গেছে। আমি ভয়ে তখন কাউকে বলিনি। পরে সন্ধ্যার দিকে ষোলশহর গিয়ে বলেছি। এরপর কামালের বাবা তাকে খুঁজেছে।’
কামাল টোকাই জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তির চেষ্টা করছিল বলে জানালেন ষোলশহর এলাকার এক এনজিওকর্মী। সামির হোসেন মোহন তার নাম, ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার কাছে কামালসহ সাতজন ছেলে এসে কাজ শিখত। এনজিওর পক্ষ থেকে তাদের কাজ শেখানোর পাশাপাশি দুপুরের খাবার খাওয়ানো হতো। আজ কামাল ও রাকিব আসেনি। তাই ষোলশহর এলাকায় এসে জানতে পারি কামাল নালায় ডুবে গেছে। দেখি কামালের বাবা তাকে নালায় খুঁজছে। এরপর আমি বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসকে জানিয়েছে। নালাগুলো উন্মুক্ত, এগুলোতে বেড়া নেই কেন?’
কামালকে উদ্ধার করতে অভিযান চালানো চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে শিশুটি নালায় পড়ে গেলেও পরিবার থেকে বিষয়টি আজ (মঙ্গলবার) ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়েছে। এরপর থেকে অভিযান চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের তিনটি স্টেশন থেকে লোকবল এসেছে, আমরা কাজ করছি। নালায় প্রচুর পরিমাণে ময়লা। আগে ময়লা পরিষ্কার করছি। আমাদের ডুবুরি দল আছে, তারাও কাজ করতেছে। কামালের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।’
এদিকে নগরবাসী বলছেন, চট্টগ্রাম যেন জীবনখেকো নালার নগরীতে পরিণত হয়েছে। নগরীর অনেক নালায় স্ল্যাব নেই। সামান্য অসাবধানতায় হুটহাট টুপ করে ভেসে যাচ্ছে জীবন।
ঘটনাস্থলে সাধন চন্দ্র ধর নামে একজন বলেন, ‘এত বড় নালাটি খোলা। এটি বেড়া দেওয়া বা স্ল্যাব বসানো দরকার। না হলে এখানে যেকেউ পরে দুর্ঘটনাতো ঘটবেই।’
গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাদামতলী এলাকায় নালায় পড়ে মারা যান সেহরিন মাহমুদ সাদিয়া নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এর আগে, গত ২৫ আগস্ট ভারি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে মুরাদপুর এলাকায় নালায় পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামের এক সবজি ব্যবসায়ী। যার খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের ৩০ জুনও ষোলশহর চশমা হিল এলাকায় খালে পড়ে যায় একটি অটোরিকশা। স্রোত থাকায় খালে তলিয়ে মারা যান চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)।
জানুয়ারির মধ্যে এই মৃত্যুফাঁদ থেকে নগরবাসী মুক্তি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র রেজাউল করিম।
কামালের ভেসে যাওয়ার স্থান পরিদর্শন করে তিনি বলেন, ‘নালায় স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। আগে যেভাবে স্ল্যাব ওঠানো ছিল, ভাঙা ছিল, এখন কিন্তু তেমন নেই। প্রায় সব নালার ওপর স্ল্যাব দিয়ে দিয়েছি। আমরা টার্গেট নিয়েছি জানুয়ারির মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর নালায় স্ল্যাব বসানো শেষ করার। তবে যে নালাগুলোতে কাজ চলছে সেগুলোতে পরে স্ল্যাব দেওয়া হবে। যেসব নালায় স্ল্যাব দেওয়া সম্ভব না সেখানে ব্যারিয়ার বা বেষ্টনী দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘কামাল ভেসে যাওয়ার এই স্থানে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে এখানে ব্যারিয়ার দেওয়া হবে।’
একদিন হয়ত জীবনখেকো নালার মুখ বন্ধ হবে নগরীতে। কিন্তু কামালের বাবার নিঃসঙ্গতা, দুঃখের দীর্ঘশ্বাস কীভাবে মুছবে- সেই প্রশ্নের উত্তরে শুধু হাহাকার।
কেএম/এইচকে