রাখে আল্লাহ, মারে কে?
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক গণমাধ্যমকর্মী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জানতে চান, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে আপনি বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কি না?’
উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কাছে চান কীভাবে বলেন তো? খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি নয়?’
২০০১ সালে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় বোমা রেখে হত্যাচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাখে আল্লাহ, মারে কে, আর মারে আল্লাহ রাখে কে? আমার বেলায় সেটা হচ্ছে, রাখে আল্লাহ, মারে কে।’
প্রশ্নকারী সাংবাদিককে আওয়ামী লীগ প্রধান পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন। বলেন, ‘আপনার পরিবারকে যদি কেউ হত্যা করত, আর সেই হত্যাকারীকে যদি কেউ বিচার না করে পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিত, তার জন্য আপনি কী করতেন?’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্মরণ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার পর খালেদা জিয়া বলল, আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। গ্রেনেড হামলায় আমাদের এতজন আহত হন, ২২ জন মারা যান, সংসদে বিষয়টি নিয়ে একদিনও আলোচনা করতে দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অমানুষ নই। অমানুষ নই দেখেই আমার এক্সিকিউটিভ অথরিটি দিয়ে তাকে বাসায় থাকার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বাকিটা আইনগত ব্যাপার।’
তিনি আরও বলেন, ‘এত বড় অমানবিক যে (খালেদা) তাকেও আমি মানবতা দেখিয়েছি। আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার, সেটুকু আমি দেখিয়েছি। আর কত চান, এখন সে অসুস্থ, এই আমি বললাম না, রাখে আল্লাহ, মারে কে; মারে আল্লাহ, রাখে কে। সেটিই মনে করে বসে থাকুন। এখানে আমার কিছু করার নেই।’
খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রশ্নের পর আরও একজন সাংবাদিক উঠে দাঁড়ান, তবে তাকে প্রশ্নের সুযোগ দেননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি আর প্রশ্ন নেব না। মানুষ এত নিষ্ঠুর আর অমানবিক হলে কাদের জন্য খাটি?’
প্রতি বছর ২৩ হাজার কোটি টাকা ডিজেলে ভর্তুকি
ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করা নিয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণের প্রতি যে দায়িত্ববোধ, তা নিয়ে আমরা সবসময় সচেতন। করোনাকালে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত কৃষক থেকে শুরু করে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই যাদের আমরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করিনি।’
তিনি বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। উৎপাদন বাড়ানোর সব ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। আমাদের তেল কিনে আনতে হয়।’
উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন, ‘কত টাকা ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হয়?’ পরে তিনি নিজেই উত্তর দেন। তিনি বলেন, ‘২৩ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষকদের জন্য সারের দাম আমরা কমিয়েছি। যে সার ৯০ টাকা ছিল তা কমিয়ে ১৫-১৬ টাকা করেছি। কৃষিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছি। কার্ড করে দিয়েছি। এখন কৃষক ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। যার মাধ্যমে ভর্তুকির টাকা সরাসরি তাদের কাছে যায়।’
তিনি বলেন, ‘করোনার সময় ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছি। সুদের হার কমিয়ে অর্ধেক সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক থাকে। শ্রমিকরা যাতে বেতন পায় তার ব্যবস্থা করেছি।’
অনেক উন্নত দেশ খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে— উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘লন্ডনে সুপারমার্কেটে সাপ্লাই নেই। খাবার জিনিস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশে খাদ্যের জন্য কোনো হাহাকার নেই।’
সবাই টাকা উপার্জন করে, ট্যাক্স কতজন দেয়— সাংবাদিকদের প্রতি এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের চাল, ডাল, বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। তারপরও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার দিকে নজর এবং এটাই বাস্তবতা। সরকারের টাকা আসবে কোথা থেকে। এখন বিদ্যুৎ সবার ঘরে ঘরে। এখানেও ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলতে পারছি না।’
৭৫ পরবর্তী হত্যাকাণ্ডে জিয়া সরাসরি জড়িত
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর সংঘটিত বিভিন্ন ক্যুতে সেনাবাহিনীর হাজার হাজার অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সরাসরি এগুলোতে জড়িত ছিলেন। তার নির্দেশে প্রহসনের বিচারের জন্য সামরিক আদালত বসানো হয়েছিল। কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন তার প্রকৃত সংখ্যা বের করা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ভোররাতে বিমানবাহিনীতে সংঘটিত বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। তখন সামরিক আদালতে ফাঁসি দেওয়া হয় ১১ জন অফিসারসহ এক হাজার ৪৫০ বিমান সেনাকে। বরখাস্ত ও চাকরিচ্যুত হন আরও চার হাজার সেনা। নিখোঁজ হন অসংখ্য। সামরিক আদালতে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা সম্প্রতি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচারের দাবি জানিয়েছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সময় আমার ফুফাত ভাই ফিরোজ কবির চৌধুরী, যিনি ক্যামেরাম্যান ছিলেন, তাকেও হত্যা করা হয়। তাদের হত্যা করে বিলের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। জেলখানায় যাদের ফাঁসি হয়েছে তাদের হয়তো খোঁজ পাব। কিন্তু কত জনকে যে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছে, জানি না। তবে আমরা তাদের বিষয়ে খোঁজ নেব। স্বজন হারানো অসহায়দের অবস্থা আমি জানি। আমিও তো আপনজন হারিয়েছি। ওই সময় নিহত অনেকের পরিবারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের শাসনামলের এত বছর পর সেই সামরিক আদালত নিয়ে সরব হয়েছেন নাগরিক সমাজ। বিষয়টি তো এতদিন কেউ তুলে ধরেনি। তবুও ধন্যবাদ, এতদিন পর কথা হচ্ছে।’
যেখানে নির্বাচনি সহিংসতা, সেখানেই ব্যবস্থা
সাম্প্রতিক সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনের সময় কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, কত মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, কত মানুষের হাত কাটা, চোখ তুলে নেওয়া কিংবা ঘর বাড়ি দখল করা হয়েছিল তার হিসাব নেই। ওই সময় দেশে কেমন সহিংসতা হয়েছিল তা ভুলে যাইনি।’
তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা হোক এটা আমরা চাই না। চেয়ারম্যান পদে আমরা প্রতীক দিচ্ছি। সেখানে কিন্তু মেম্বারদের ভোটও হয়, আমরা প্রতীক দিই না। এই অবস্থায় মেম্বারদের পদেও কিন্তু গোলমাল হয়। প্রতীক দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে শুধু গোলমাল হয় সেটা কিন্তু নয়। মেম্বারদের প্রতীক ছাড়া নির্বাচনেও কিন্তু গোলমাল হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৃণমূলে এমন হয়, একজনকে নমিনেশন দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে আরও অনেকের আকাঙ্ক্ষা থেকে যাচ্ছে। তবে ইলেকশন কিন্তু সবাই করছে। আমরা যেমন নির্বাচন আওয়ামী লীগের নামে করছি, বিএনপি কিন্তু নাম ছাড়া করছে, অন্যান্য দলও করছে। হানাহানি-মারামারি কোথায় কোথায় হচ্ছে, কাদের মধ্যে হচ্ছে, সেটা যদি আমাদের দলের মধ্যে হয় তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের দলের নেতৃত্ব ইউনিয়ন পর্যায়ে হোক, ওয়ার্ড পর্যায়ে হোক বা উপজেলা পর্যায়েই হোক যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করবে তদের বিরুদ্ধে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। নির্বাচন নিয়ে যেখানে যেখানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে আমরা ব্যবস্থা নেব এবং নিচ্ছি।’
২৫ কোটি ভ্যাকসিন কেনা হয়েছে
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভ্যাকসিন অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। অনেক দাম দিয়ে ২৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনেছি। শুধু করোনার টেস্ট বাবদ খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ৮-৯ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। বাকিদের প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। পেশাজীবী, শ্রমিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। কেউ ভ্যাকসিন থেকে বাদ যাবে না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ইউনেস্কো কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদানের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি মুজিববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে এই পুরস্কার প্রবর্তন সবচেয়ে উপযুক্ত সম্মান।’
বিশ্বকাপ নিয়ে হতাশ নন প্রধানমন্ত্রী
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরমেন্স নিয়ে এক সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চান। জবাবে তিনি বলেন, ‘খেলা দেখে আপনারা এত হতাশ হন কেন? আমি হতাশা দেখতে চাই না। কয়েকটা খেলা তারা চমৎকার খেলেছে।’
উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্রিকেট খেলেছেন কখনো, মাঠে গেছেন কখনো? ব্যাট-বল ধরেছেন? ধরেননি। সেজন্য জানেন না। কথায় কথায় এত হতাশ হওয়া ঠিক নয়। এটা আমাদের একটা রোগের মতো হয়ে গেছে, একটুতেই হতাশ, একটুতেই উৎফুল্ল। মাঝে-মধ্যে ধৈর্য ধরে থাকেন। আগামীতে আরও ভালো করবে তারা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘হ্যাঁ, ফলাফল যেটা আমরা আশা করেছিলাম সেটা হয়নি। তবে এজন্য আমি আমাদের ছেলে-পেলেদের নিয়ে কখনো হতাশা প্রকাশ করি না। আমি বলি, আরও ভালো খেলো, আরও প্র্যাকটিস করো।’
তিনি বলেন, ‘একে তো করোনার জন্য তারা ঠিকমতো প্র্যাকটিস করতে পারেনি, এর মধ্যে যে বিশ্বকাপে খেলেছে, কয়েকটি দেশকে হারাতে পেরেছে এটাই বড়। আমি চাচ্ছি তাদের কীভাবে আরও বেশি জয়ী করানো যায়।’
প্রধানমন্ত্রী ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত গ্লাসগো, লন্ডন ও প্যারিস সফর করেন। সফরকালে তিনি কপ-২৬ সম্মেলন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন ২০২১, ইউনেস্কো সদর দফতরে সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান, ইউনেস্কোর ৪১তম সাধারণ সম্মেলন, প্যারিস শান্তি ফোরাম, ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রায় দুই সপ্তাহের সফর শেষে গত ১৪ নভেম্বর দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সফর নিয়েই বুধবার সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।
আরএইচ