বাবার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে ঢাকায় এসে মৃত্যুর কোলে আমিনুল
১৫ বছর আগে আমিনুল ইসলামের (৩৫) বাবা আব্দুর রশীদ মারা যান। গত ২৮ অক্টোবর বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে কারখানা থেকে ছুটি নিয়ে মানিকগঞ্জ সদরের আইমারায় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন আমিনুল।
বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পালন করে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকায় এসে সারাদিন কারখানায় জুতা বানানোর কাজ শেষে রাতে দোতলায় যান ঘুমাতে। এ ঘুমই হলো আমিনুলের জীবনের শেষ ঘুম।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর সোয়ারীঘাটের কামালবাগে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে জুতার কারখানায় লাগা আগুনে ঘুমের মধ্যে দগ্ধ হয়ে মারা যান শ্রমিক আমিনুল ইসলাম। আগুনে আমিনুল এতটাই দগ্ধ হয়েছেন যে তাকে ঠিকভাবে চিনতে পারছেন না স্বজনরা। তার পরনে থাকা লুঙ্গি ও গেঞ্জির পুড়ে যাওয়া অংশ দেখে স্বজনরা শনাক্ত করতে পারলেও একই মরদেহের আরও দাবিদার থাকায় মরদেহটি এখনও দেওয়া হয়নি পরিবারের কাছে। ডিএনএ টেস্টের আগে মরদেহ হস্তান্তর করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা।
তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট আমিনুল ইসলাম। ছোট ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে বড় বোন মোসাম্মৎ বিলকিসকে আহাজারি করতে দেখা যায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে। শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আদরের ছোট ভাইয়ের মরদেহ না নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাকে।
মর্গের সামনে ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে বিলকিস ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে আব্বার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা সব ভাই-বোনরা বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেই সময় আমিনুলও বাড়িতে গিয়েছিল। আমরা সবাই মিলে কত গল্প করেছি একসঙ্গে আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে। আমরা সবাই যার যার মতো নিজ নিজ বাড়িতে চলে আসলেও আমিনুল কিছুদিন বাড়িতে থেকে যায়। তার স্ত্রী ও তিন ছেলে বাড়িতেই থাকে। সে অনেক দিন পর পর ছুটিতে যায় বলে বউ ও ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য কয়েকটা দিন থাকে।
তিনি বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) সে ছুটি কাটিয়ে কারখানায় এসে সারাদিন কাজ করে। কাজ শেষে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যেই আমার ছোট ভাই না জানি কত কষ্টে আগুনে পুড়ে মারা গেছে। আমার ভাইয়ের লাশটি দেখে আমি কোনোভাবেই চিনতে পারি না। আগুনে পুড়ে তার শরীরের কোনো কিছুই বাকি নেই। আমাদের সবার ছোট ভাই, আমাদের সবার আদরের ভাইটার এত কষ্টে মৃত্যু হবে কোনো দিন চিন্তাও করিনি।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাইছড়া গ্রামের আবুল হাসেম মির্জার ছেলে মনির হোসেনেরও (৩২) মৃত্যু হয় এ অগ্নিকাণ্ডে। শারীরিক অসুস্থতা থাকার কারণে বেশ কয়েকদিন বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে দুই দিন আগে ঢাকায় আসেন মনির। গত ১০ বছর ধরে মনির হোসেন কারখানাটিতে মেশিন ম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন।
আগামী এক-দুদিন পর দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানকে নিয়ে তার স্ত্রীর ঢাকায় বেড়াতে আসার কথা ছিল। মনির কারখানায় থাকেন। তাই স্ত্রী ও সন্তানদের খালা শাশুড়ির ছেলে মো. আলীকে বলে রেখেছিলেন তার বাসায় কিছুদিন রাখতে। বাড়ি থেকে আসার সময় মনির স্ত্রী ও সন্তানদের কথা দিয়ে এসেছিলেন তারা ঢাকায় এলে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাবে। কিন্তু মনির কথা না রেখে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
বোনের স্বামী মনির হোসেনের মৃত্যুর বিষয়ে মো. আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েকদিন আগে দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। দুলাভাই আমাকে বলেছিল তোমার বোন ও ভাগিনা-ভাগ্নেরা ঢাকায় বেড়াতে আসবে। আমি তো কারখানায় থাকি। তাই তাদের তোমার বাসায় সপ্তাহখানেক রাখব। আমি নিজেও সোয়ারীঘাট এলাকার একটি জুতার কারখানায় কাজ করি। তবে আমি আমার পরিবার নিয়ে ওই এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকি।
তিনি বলেন, দুলাভাই আমার কাছে বলেছিল তারা (স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে) বাড়ি থেকে এলে তাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাবেন। কিন্তু আমার বোন তো এখন ঠিকই আসছে। আমার দুলাভাই আর নেই। কথা ছিল বোন আমরা সবাই ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরব। কিন্তু এখন দুলাভাইয়ের মরদেহ শনাক্ত করা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার উলুকান্দি গ্রামের শহর আলীর ছেলে শামীম মিয়ার (৩৫) মরদেহ বাড়ি নিয়ে যেতে পারছেন না বড় ভাই জসীম উদ্দীন। তিনি বলেন, আমার ভাই তো চলে গেছে আজ সকালে আমি খবর পেয়েছি। খবর পাওয়ার পর আমি ভৈরব থেকে দ্রুত ঢাকায় আসি। মরদেহ শনাক্ত করার পরও পুলিশ বলছে ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ নিয়ে যেতে দেবে না। আমরা তো যা হারানোর হারিয়েছি, এখন চাই মরদেহটা বাড়িতে নিয়ে যেতে।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত হওয়া বাকি দুই জনের স্বজনরাও একইভাবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন। স্বজনরা এভাবে আগুনে পুড়ে মারা যাবেন, তা কেউই মানতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে সোয়ারীঘাট এলাকার জুতার কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা কাজ করে রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় কারাখানা থেকে পাঁচ শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
নিহতরা হলেন- মানিকগঞ্জ সদরের আইমারা গ্রামের মৃত আব্দুর রশীদের ছেলে আমিনুল ইসলাম (৩৫), চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাইছড়া গ্রামের আবুল হাসেম মির্জার ছেলে মনির হোসেন (৩২), বরিশালের মুলাদী উপজেলার ছবিপুর গ্রামের সেকান্দার মৃধার ছেলে আব্দুর রহমান রুবেল (৪০), কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার উলুকান্দি গ্রামের শহর আলীর ছেলে শামীম মিয়া (৩৫), শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলার চক্করিয়া গ্রামের মৃত সাইফুল ইসলামের ছেলে কামরুল হাসান কামরুল (২৬)।
এমএসি/এসএসএইচ