এক লাশের দাবিদার তিন পরিবার
‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়’। বিখ্যাত এই সংলাপ অনুযায়ী মরে গেলে হয়তো পচে যায় কিন্তু মানুষ পুড়ে গেলে কী হয়? পুড়ে গেলে কয়লা হয়, তখন লাশ চিনতে কষ্ট হয় স্বজনের। সারি করা লাশের সামনে অপলক চেয়ে থাকেন স্বজনেরা। অপেক্ষায় থাকেন কখন ডিএনএ টেস্ট হবে। কখন জানা যাবে পুড়ে অঙ্গার হওয়া এই মরদেহ তারই প্রিয়জনের।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে রাজধানীর সোয়ারীঘাটে জুতার কারখানায় আগুন লাগে। রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের ওই কারখানায় বার্মিজ ও স্পন্সের জুতা তৈরি হতো। কারখানাটিতে জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত রাবার, প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল-ভর্তি অনেক ড্রাম ছিল। এসব দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।
এতে প্রাণ হারান পাঁচজন। এরমধ্যে চারটি মরদেহের পরিচয় নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। কারণ লাশগুলো পুড়ে গেছে। একটি লাশের দাবিদার তিনটি পরিবার। আরেকটির দাবিদার দুই পরিবার। বাকি দুই মরদেহের কোনো স্বজনের খোঁজ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) কর্তৃপক্ষকে নিতে হয়েছে মরদেহের ডিএনএ টেস্টের সিদ্ধান্ত। ফলে পুড়ে অঙ্গার হওয়া মানুষের স্বজনদের অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ ২১টি দিন।
শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) ভিড় করেন নিহতদের স্বজনরা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও মরদেহ শনাক্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি প্রশাসন।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাইছড়া গ্রামের আবুল হাসেম মির্জার ছেলে মনির হোসেনের (৩২) শ্যালক মো. আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দুলাভাইয়ের গালে একটি টিউমার ছিল। আগুনে দগ্ধ হয়ে সেটি গোলাকার হয়ে গেছে। টিউমার ও তার মুখ দেখে আমরা চিনতে পেরেছি। কিন্তু আরও দুই পরিবার এই মরদেহটি তাদের স্বজনের বলে দাবি করছে। পুলিশ বলছে, ডিএনএ টেস্ট ছাড়া দুলাভাইয়ের লাশ পাব না।
এদিকে ওই মরদেহটি নিজের ফুপাতো ভাই কামরুল হাসানের দাবি করে দেলোয়ার হোসেন দুলাল নামে একজন বলেন, আমার ফুপি আমাকে ফোন করে বলেছেন, কামরুল বাম হাতের মধ্যমা আঙুলে আংটি পরত। ওই মরদেহের একই আঙুলে আংটি দেখেছি। কামরুলের শরীরের গঠনের সঙ্গেও মরদেহের মিল রয়েছে। কিন্তু আরও দুই পরিবার বলছে এটি তাদের স্বজনের মরদেহ!
আরেকটি পরিবারের সদস্যরা নানা চিহ্ন ও পরনের কাপড় দেখে মরদেহটি তাদের স্বজন রুবেলের বলে দাবি করছে।
মিডফোর্ড হাসপাতালের মর্গে রাখা এই মরদেহকে মনির হোসেন (৩৫), আব্দুর রহমান রুবেল (৪০) ও কামরুল হাসানের (২৬) পরিবারের সদস্যরা নিজেদের স্বজন দাবি করায় তৈরি হয়েছে জটিলতা।
একই হাসপাতালে রাখা আরেকটি লাশকে আমিনুল ইসলাম (৩৫) ও শামীম মিয়ার (৩৫) মরদেহ বলে দাবি করছেন দুই পরিবারের সদস্যরা। এদিকে, অন্য দুইটি মরদেহের কোনো দাবিদার এখনো নেই।
আমিনুলের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মরদেহের লুঙ্গি-গেঞ্জির পোড়া অংশ দেখে নিশ্চিত হয়েছি এটি আমিনুলের মরদেহ। আর শামীমের বড় ভাই জসীম উদ্দিন দাবি করছেন, মরদেহের শরীরের গঠন ও পোড়া মুখমণ্ডল দেখে মনে হচ্ছে এটি তার ভাইয়ের মরদেহ।
স্বজনদের এমন পাল্টাপাল্টি দাবিতে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহের ডিএনএ টেস্টের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে মরদেহের প্রকৃত পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ২১ দিন সময় লাগবে। ফলে ২১টি দীর্ঘ দিবস-রজনী বুকে পাথর বেঁধে স্বজনদের মরদেহের জন্য করতে হবে অপেক্ষা। এরপর জানতে পারবেন কোন মরদেহ আসলে কার স্বজনের।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিটের পরিদর্শক মো. সাইফুর রহমান ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, মরদেহগুলো এমনভাবে দগ্ধ হয়েছে যে, চেনার উপায় নেই। একাধিক পরিবার একই মরদেহ তাদের স্বজনের বলে দাবি করছে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে উপস্থিত ঢাকা জেলা প্রশাসনের তেজগাঁও সার্কেলের অফিস সহকারী মো. জালাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসেছিলাম মরদেহ ও পরিবারের সদস্যদের শনাক্ত করতে। এর ভিত্তিতে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আর্থিক সাহায্যের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মরদেহ চেনার উপায় না থাকায় ডিএনএ টেস্ট করা হবে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে সোয়ারীঘাট এলাকায় রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে জুতার কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা কাজ করে রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এমএসি/এইচকে/জেএস