রাউজানে নির্বাচন মানেই ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জয়ী!
চট্টগ্রামের রাউজানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব প্রার্থীই ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হচ্ছেন। এ ধারা গত ছয় বছর ধরেই অব্যাহত। এ কারণে রাউজানের প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৭৬০ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি নির্বাচনী আমেজও সেখানে অনুপস্থিত।
আগামী ২৮ নভেম্বরের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের সদস্যরাও। নির্বাচিত সব জনপ্রতিনিধি ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা গণতন্ত্রের জন্য এবং সুশাসনের জন্য হুমকি। আমরা চাইব, নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। যাতে মানুষ অবাধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। এরপর আবার নতুন করে শিডিউল দিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এ নির্বাচনের জন্য ১৪ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকের ১৪ জন প্রার্থীই মনোনয়ন দাখিল করেছেন। একইভাবে ১৪ ইউনিয়নের ১২৬ ওয়ার্ডেও মেম্বার পদে একজন করে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। আর সংরক্ষিত নারী মেম্বার পদের ৪২ আসনের বিপরীতে ৪২ জনই মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এসব পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাউজান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা অরুণ উদয় ত্রিপুরা। তিনি বলেন, রাউজান উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রতিটি পদে একজন করেই প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। মনোনয়ন ফরম নিতে বা জমা দিতে বাধা দিয়েছে এমন কেউ অভিযোগ করেননি।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের সব প্রার্থী জয়লাভের ব্যাপারে রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আবদুল ওহাব ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা কোনো কিছুই করিনি। দলের সিদ্ধান্ত মতো তিনজন করে তালিকা পাঠিয়েছি কেন্দ্রে। দল থেকে একজন করে মনোনয়ন দিয়েছে। অন্য কেউ নির্বাচন না করলে তার দায়-দায়িত্ব তো আমাদের না। যে কেউ চাইলেই নির্বাচন করতে পারতেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ১৪টি ইউনিয়নে কমিটি আছে, ওয়ার্ডেও কমিটি আছে। আমরা সবার সঙ্গে সভা করেছি। সবার সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের তালিকা পাঠিয়েছি। সেখান থেকে একজন করে প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। দলের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখে রাউজানে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়নি। আর ওয়ার্ডগুলোতেও ওয়ার্ড কমিটি মিটিং করে আমাদের দলের মেম্বার ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর ঠিক করেছেন। সেখানে মেম্বার পদে অন্য কেউ নির্বাচন না করলে আমাদের কী করার আছে?
রাউজানে অন্যদলের ও স্বতন্ত্রভাবে আপনাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ নির্বাচন করছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্যরা কেন নির্বাচন করছে না তা তো আমরা বলতে পারব না। এছাড়া অন্যদলের কেউ প্রকাশ্যে রাজনীতি করে না এখানে।
আওয়ামী লীগের বাছাই করা প্রার্থী ছাড়া অন্য কাউকে রাউজানে নির্বাচন করতে দেওয়া হয় না এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, কাউকে নির্বাচন করতে বাধা দেওয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এ অভিযোগ আসে বলে মনোনয়ন জমা দেওয়ার তারিখ শেষ হওয়ার একদিন আগে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এখানে সবকিছু ফ্রি ছিল, ফেয়ার ছিল, কেউ কাউকে বাধা দেয়নি। কেউ নির্বাচন করার ইচ্ছে থাকলে করতে পারত। কেউ বলতে পারবে না আমরা কাউকে মনোনয়ন নিতে বা জমা দিতে বাধা দিয়েছি। আমরা চাই সবাই যার যার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করুক।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজানের সংসদীয় আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। এরপর থেকে রাউজানে স্থানীয় সরকারের প্রায় সব পর্যায়ের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রচলন শুরু হয়
রাউজানের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও ভোট দিতে পারিনি। সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। আবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের কোনো আমেজ নেই রাউজানে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাউজানের এক বাসিন্দা বলেন, অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে নির্বাচন করেননি। তারা জানেন সরকারি দলের সাপোর্ট ছাড়া নির্বাচনে জয়লাভ করা সহজ হবে না।
রাউজান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন , আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজানের সংসদীয় আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। এরপর থেকে রাউজানে স্থানীয় সরকারের প্রায় সব পর্যায়ের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রচলন শুরু হয়। অবশ্য ২০১৫ সালে রাউজান পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে ভোট হয়। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মধ্যে ১১টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এরপর ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।এছাড়া ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র ও সাধারণ ওয়ার্ডের ১২ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এ নির্বাচনের জন্য ১৪ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকের ১৪ জন প্রার্থীই মনোনয়ন দাখিল করেছেন। একইভাবে ১৪ ইউনিয়নের ১২৬ ওয়ার্ডেও মেম্বার পদে একজন করে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। আর সংরক্ষিত নারী মেম্বার পদের ৪২ আসনের বিপরীতে ৪২ জনই মনোনয়ন জমা দিয়েছেন
সুশাসনের জন্য নাগিরক চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন , নির্বাচন বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনীহা, অনাস্থা, অবিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করছি। সেক্ষেত্রে রাউজান উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবাই নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় নতুন মাত্রা যুক্ত হলো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের নির্বাচন কমিশন বোবা ও কানা হয়ে গেছে। তারা তাদের দায়বদ্ধতা ধরে রাখার জন্য হলেও এ জায়গায় হস্তক্ষেপ করা দরকার ছিল। সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল সরকারি দলের।
২০১৫ সালে রাউজান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মেয়র পদে নির্বাচিত হন দেবাশীষ পালিত। সে সময়ে তিনি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দেবশীষ পালিত স্থানীয় রাজনীতিতে রাউজানের সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর বিরোধী ধারার নেতা হিসেবে পরিচিত।
নিজের পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে দেবাশীষ পালিত ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ৬-৭ মাস অফিস করতে পেরেছি। পরে আর নিয়মিত অফিস করতে পারিনি। রাউজানের রাজনৈতিক অবস্থার কারণে। এখানে কোনো পরিবেশ নেই। সেখানে সবকিছু এককভাবে চলে। রাউজানে কথা বলার তেমন পরিবেশ নেই।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত রাউজান পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু জাফর চৌধুরীকে। হুমকি এবং নানামুখী চাপে শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি বলে অভিযোগ আবু জাফর চৌধুরীর।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাউজানে যেভাবে চলার সেভাবে চলছে। সবাই নীরব। আমারও নীরব থাকা ভালো। আমি আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।
রাউজানের বাসিন্দা উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জসিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরো দেশে তো গণতান্ত্রিক কোনো সিস্টেম নেই। সব জায়গায় জোর করে নিয়ে নিচ্ছে। আর এবার তো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিচ্ছে না। স্বতন্ত্রভাবে রাউজানে নির্বাচন করার ইচ্ছা থাকলেও অনেকে তা সাহস করতে পারছে না।
কেএম/এসকেডি