পথে বসেছেন ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ারহোল্ডাররা
একদিকে ঋণগ্রস্ত, অন্যদিকে ফ্লাইটও বন্ধ। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডের শেয়ার কিনে পথে বসেছেন ৮২ কোটি শেয়ারহোল্ডার। বিনিয়োগকারীরা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে কোম্পানির ফেসভ্যালু ১০ টাকার শেয়ার এখন এক টাকায় নেমে এসেছে। তারপরও বিক্রি হচ্ছে না শেয়ার।
অন্যদিকে ২০১৬ সাল থেকে ফ্লাইট বন্ধ। পাশাপাশি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)-চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রয়েছে মামলা। কোম্পানির অফিসও বন্ধ।এমডি-চেয়ারম্যানসহ উদ্যোক্তা পরিচালকদের বেশির ভাগই দেশত্যাগ করেছেন। ফলে শেয়ারধারীরা পুঁজি ফিরে পাবার আর কোনো আশাও দেখছেন না। দুর্বল মৌলভিত্তির এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে আম-ছালা দুই-ই গেছে বিনিয়োগকারীদের।
কোম্পানির তথ্য মতে, উদ্যোক্তাদের শতভাগ মালিকানার কোম্পানিটি এখন সাড়ে ৯৭ শতাংশ মালিকানা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। অর্থাৎ কোম্পানির এ ৯৭ শতাংশ শেয়ার বিনিয়োগকারীদের হাতে বিক্রি করে দিয়ে এক হাজার ২১০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা।
উদ্যোক্তাদের শতভাগ মালিকানার কোম্পানিটি এখন সাড়ে ৯৭ শতাংশ মালিকানা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। অর্থাৎ কোম্পানির এ ৯৭ শতাংশ শেয়ার বিনিয়োগকারীদের হাতে বিক্রি করে দিয়ে এক হাজার ২১০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা
এর মধ্যে প্রথম দফায় অর্থাৎ ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৩৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানি থেকে প্রায় ৮২৪ কোটি ২২ লাখ টাকা তুলে নেন তারা। আরও কয়েক দফা ইউনাইটেড এয়ারের প্লেন আকাশে উড়বে— এমন আশ্বাসে বাকি শেয়ারও বিক্রি করে দেন উদ্যোক্তারা।
এখন নতুন করে যাতে কোনো বিনিয়োগকারী প্রতারিত না হন, সেজন্য কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। তালিকাচ্যুত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে ভাবছে না দুই স্টক এক্সচেঞ্জও। এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ইউনাইটেড এয়ারের বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু করার ক্ষমতাও আমাদের নেই।
ইউনাইটেড এয়ারের বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু করার ক্ষমতাও আমাদের নেই
ডিএসই পরিচালক রকিবুর রহমান
পুঁজিবাজারের মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কোম্পানিটিকে তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। এরপর কী করা যায় সে দিকে নজর রাখা হচ্ছে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কমিশনের উচিত কোম্পানিটির সব সম্পদের তথ্য জানা। এরপর সম্পদগুলো বিক্রি করে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে ফেসভ্যালুর সমান অর্থ বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া।
কমিশনের উচিত কোম্পানিটির সব সম্পদের তথ্য জানা। এরপর সম্পদগুলো বিক্রি করে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে ফেসভ্যালুর সমান অর্থ বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
এ বিষয়ে কমিশনের নির্বাহী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে একাধিকবার শুনানিতে ডেকেছি। তাদের কেউ কমিশনে উপস্থিত হননি। ফলে কোম্পানির এমডি ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তারপরও তাদের খুঁজে না পাওয়ায় কোম্পানিটিকে তালিকাচ্যুত করেছি। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপদ রাখতে সবধরনের চেষ্টা চলছে।’
আমরা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে একাধিকবার শুনানিতে ডেকেছি। তাদের কেউ কমিশনে উপস্থিত হননি। ফলে কোম্পানির এমডি ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তারপরও তাদের খুঁজে না পাওয়ায় কোম্পানিটি তালিকাচ্যুত করেছি
কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম
মূল মার্কেট থেকে তালিকাচ্যুতের বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না ইউনাইটেড এয়ারের বিনিয়োগকারীরা। তারা বরং উল্টো কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, কোম্পানিটি তালিকাচ্যুত করার আগে অন্যান্য কোম্পানির মতো ইউনাইটেড এয়ারের পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারত। এতে যদি কাজ না হতো তবে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারত। যেভাবে আলহাজ টেক্সটাইল মিলসে প্রশাসক নিয়োগ করেছে। কিন্তু তা না করে কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে আরও সুযোগ করে দিল।
প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী মুবিনুল ইসলাম অন্তু ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশন রহিমা ফুডের মতো কোম্পানিকে ওটিসি থেকে মূল মার্কেটে আনল। আর আমাদের কথা চিন্তা না করেই ইউনাইটেড এয়ারকে তালিকাচ্যুত করল। মূল মার্কেটে থাকলে কিছুটা হলেও সুশাসনে থাকত। কিন্তু এখন অনিয়ম করা আর সহজ হলো। কমিশন আসলে কার পক্ষে— প্রশ্ন তার।
আমাদের কথা চিন্তা না করেই ইউনাইটেড এয়ারকে তালিকাচ্যুত করল। মূল মার্কেটে থাকলে কিছুটা হলেও সুশাসনে থাকত। কিন্তু এখন অনিয়ম করা আর সহজ হলো। কমিশন আসলে কার পক্ষে
ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারী মুবিনুল ইসলাম অন্তু
এস এম জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানিটি ‘বিমান আকাশে উড়বে’— এমন টোপ (ফাঁদ) দিয়ে একের পর এক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ভালো হবে ভেবে আমি নতুন করে বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন পথে বসেছি। আমি এর বিচার চাই।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানিটিকে আরও আগেই পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করার দরকার ছিল। তাহলে গত ৪-৫ বছরে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ক্ষতি থেকে রক্ষা পেত। দ্রুত কমিশনকে এসব জঙলি কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করতে হবে।
তিনি বলেন, কোম্পানিটির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিটিতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ইউনাইটেড এয়ার দেশের আকাশে ২০০৭ সালে ফ্লাইট চালু করে। তালিকাভুক্ত হওয়ার পরের বছর ২০১১ সালে তাদের হাতে থাকা ৫০ শতাংশ শেয়ারের ৩৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ওই বছর শেয়ারের গড় দাম ছিল ৪৬ দশমিক ৪০ পয়সা। সেই হিসেবে পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি করে প্রায় ৭৬৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা তুলে নেয়।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ শেয়ার ২৩ দশমিক ৭০ টাকা গড় দামে বিক্রি করে তারা প্রায় এক কোটি ৩২ লাখ টাকা তুলে নেয়। ২০১৩ সালে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ শেয়ার ২০ দশমিক ৩১ টাকা গড় দামে বিক্রি করে ৪৫ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার ৯ দশমিক ৯২ টাকা গড় দামে বিক্রি করে প্রায় সাড়ে নয় কোটি টাকা তুলে নেয়।
এছাড়া ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ দশমিক ০২ শতাংশ শেয়ার গড়ে ছয় টাকা দামে বিক্রি করে। সবমিলিয়ে ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০টি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে প্রায় ৮২৪ কোটি ২২ লাখ টাকা তুলে নেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
প্রতারণার নতুন ফাঁদ
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে সামনে রেখে বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন দু’দফায় কোম্পানিটিকে ৬২৪ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়। প্রথম দফায় ইউনাইটেড এয়ারকে রাইট শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ২২৪ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবিসহ কোনো প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করতে আসেনি।
এরপর বিদেশিদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে ৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমতিও কাজে লাগায়নি কোম্পানিটি। উল্টো এ সময়ে কোম্পানির প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে চলে যান উদ্যোক্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। একই বছরে তাদের (উদ্যোক্তা) হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ দফায় আর ২২০ কোটি টাকা তুলে নেন উদ্যোক্তারা। এরপর থেকে শেয়ারের দাম কমতে থাকে। যা এখন ১ টাকা ৯০ পয়সায় ঠেকেছে।
এ বিষয়ে কোম্পানির এমডি ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি বিদেশে থাকায় সংযোগ পাওয়া যায়নি। ইউনাইটেড এয়ারের পরিচালক শিহাব উদ্দিনকেও পাওয়া যায়নি। গত ২০ জানুয়ারি কোম্পানির উত্তরা অফিসে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
ঋণগ্রস্ত ইউনাইটেড এয়ার
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, ইউনাইটেড এয়ার দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্লেনের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। বারবার চিঠি দেয়ার পরও তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এছাড়া এখন পর্যন্ত অ্যারোনেটিক্যাল ও নন-অ্যারোনেটিক্যাল, সবমিলিয়ে ইউনাইটেড এয়ারের কাছে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা পাওনা আছে বেবিচকের।
অপরদিকে কোম্পানিটির দীর্ঘমেয়াদী ঋণ রয়েছে ১৭৬ কোটি ৩৭ লাখ ৮ হাজার টাকা। স্বল্পমেয়াদী ঋণ রয়েছে ১১৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক তৌহিদ-উল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউনাইটেড এয়ারের আটটি প্লেন দীর্ঘদিন ধরে এয়ারপোর্টে পড়ে আছে। সবমিলিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড এয়ারের কাছে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা পায়। বারবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
দীর্ঘদিন ধরে সাড়া না দেওয়ায় তাদের উড়োজাহাজগুলো বাজেয়াপ্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাজেয়াপ্তের পর উড়োজাহাজগুলো নিলাম করা হবে। নিলামের প্রাপ্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে— জানান তৌহিদ-উল আহসান।
ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা জানান, কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছিল। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি ২০১১ সালে একটি শেয়ারে বিপরীতে একটি শেয়ার ছেড়ে টাকা উত্তোলন করে। ওভার দি কাউন্টার মার্কেটে লেনদেন হওয়া ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ার গত ১৪ জানুয়ারি লেনদেন হয়েছে ১ টাকা ৯০ পয়সায়।
একাধিক মামলা
উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারায় ২০১৬ সাল থেকেই সবধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ইউনাইটেড এয়ারের। এরপর বেবিচক ও ইউনাইটেড এয়ার পাল্টাপাল্টি মামলা করে। এছাড়া উড়োজাহাজগুলো কেনায় আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোম্পানিটির তৎকালীন পরিচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল।
এমআই/এমএআর/এমএইচএস