দুই কারণে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে ফাটল
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটে এম এ মান্নান উড়াল সড়কের (ফ্লাইওভার) র্যাম্পের দুটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটলের কারণে কালুরঘাটমুখী অংশে যানচলাচল বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে এ ফাটল মেরামত করতে একমাস সময় লাগবে।
তবে কেন এ ফাটল দেখা দিলো, এ প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে গেলে প্রকৌশলীরা জানালো, দুই কারণে পিলারে ফাটল দেখা দিতে পারে। প্রথমত ডিজাইন বা কনস্ট্রাকশন ত্রুটির কারণে পিলারে ফাটল হতে পারে। অন্যদিকে অতিরিক্ত ভারী যানবাহন চলাচলের কারণেও এ ফাটল দেখা দিতে পারে।
জানা যায়, ফ্লাইওভারের মূল ডিজাইনে ফাটল সৃষ্টি হওয়া ওই র্যাম্প ছিল না। এটি মূল ফ্লাইওভার তৈরির তিনবছর পর নির্মাণ করা হয়েছে।
আর ফ্লাইওভার বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলছেন, ভারী যানবহন চলাচল করার জন্য এ ফ্লাইওভারের ডিজাইন করা হয়নি। ভারী যানবহন চলাচলের কারণে পিলারে ফাটল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এক মাসের মধ্যে পিলারে ফাটলের রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।
সিডিএ সূত্র জানায়, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের মার্চে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর নির্মাণ কাজ চলাকালে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ১৪ জন নিহত হন। এরপর মূল ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ২০১৩ সালে মূল ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করা হয়। ১ হাজার ৩৩২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ মিটার প্রস্থ ফ্লাইওভারটি করতে ব্যয় হয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর কালুরঘাটমুখী র্যাম্পের উদ্বোধন করা হয়।
জানা গেছে, মূল ফ্লাইওভারের নকশায় এ র্যাম্প ছিল না। পরে এই র্যাম্প সংযোজন করা হয়েছে। আর এই র্যাম্পের বহদ্দারহাট মোড় এলাকায় দুটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। এরপর থেকে ফ্লাইওভারের কালুরঘাটমুখী র্যাম্পে সবধরনের যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রামের সবগুলো ফ্লাইওভারই নির্মাণ করছে সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)। বহদ্দারহাটে এম এ মান্নান ফ্লাইওভারসহ চারটি ফ্লাইওভার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে সিডিএ।
ফ্লাইওভারের পিলার ফাটল নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ ফ্লাইওভার চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে নিমার্ণ করা হয়েছে। এই ফাটল দুই কারণে হতে পারে। একটা হতে পারে ডিজাইন ত্রুটির কারণে, আরেকটি হচ্ছে কনস্ট্রাকশন ত্রুটি থেকে। তবে এ মুহূর্তে বলা যাবে না— এটা ডিজাইন নাকি কনস্ট্রাকশন ত্রুটি। তবে এটা যে কোনো কারণে হতে পারে। এটা ওভারলোডের গাড়ি চলাচল করার কারণে হতে পারে। আমারা নির্মাণকারী সংস্থা ম্যাক্সের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি এই র্যাম্পটা ফ্লাইওভারের মূল ডিজাইনে ছিল না। পরে তা করা হয়েছে। যেহেতু মূল ডিজাইনে ছিল না তাই মনে করছি ডিজাইনের একটা ত্রুটি থাকতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পিলারের ফাটলের ব্যাপারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হবে। যেহেতু ফ্লাইওভারের নির্মাণ, ডিজাইন তারাই করেছিল। তারাই পিলারের মেরামতের ব্যবস্থা করবে। কারণ তারাই জানবে কী পরিমাণ লোড নিতে পারবে র্যাম্পটি। কীভাবে ডিজাইন করা হয়েছে।'
এই ফাটলের ফলে দুর্ঘটনার কতটুকু আশঙ্কা রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাধরণত যে কোনো ফাটল ধীরে ধীরে বাড়ে। যেহেতু গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হয়েছে, আপতত পিলারের ফাটলটি বাড়ার সুযোগ নেই।’
নিচে দিয়ে গাড়ি চলাচল করলে কম্পনে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভবনা আছে কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিচের গাড়িতে যে ধরনের কম্পন হয় তাতে দুর্ঘটনার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযের পুরকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফতাবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের যে অংশে ফাটল তৈরি হয়েছে তার কাজ মূল ফ্লাইওভারের দুই তিন বছর পরে শুরু হয়েছিল। ঠিক কী কারণে হঠাৎ ফাটল দেখা দিয়েছে তা স্ট্রাকচারের ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন ছাড়া বলা খুব কঠিন। এখানে ডিজাইন এবং কনস্ট্রাকশন, বিশেষত কনস্ট্রাকশনের সময় সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে কিনা সেটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলে কারণ বের করা যেতে পারে। তবে ডিজাইনের সময় সঠিকভাবে কোড অনুসরণ করে করা হয়েছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। সাধারণত কংক্রিটের স্থাপনাগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে হঠাৎ করে বড় ফাটল অথবা ধসে পড়ার মত ঘটনা না ঘটে।'
এবিষয়ে ফ্লাইওভার বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন , ‘ভারী যানবাহন চলাচল করার জন্য ফ্লাইওভারের এই র্যাম্পটার ডিজাইন করা হয়নি। এটা পরে মূল ফ্লাইওভারের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এটা যখন ২০১৭ সালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, তখন র্যাম্পে ওঠার মুখে ব্যারিয়ার দেওয়া ছিল। যাতে করে ভারী যানবহন চলাচল করতে না পারে। সিটি কর্পোরেশনকে যখন ফ্লাইওভার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হস্তান্তর করা হয়, তখনও ব্যারিয়ার ছিল। পরবর্তী সময়ে কেন ব্যারিয়ার খুলে দিয়ে ভারী যানবাহন চলতে দিয়েছে তা আমরা জানি না। ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য এটা ডিজাইন করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পিলারে যে অংশে ফাটল আশে তা মেরামত করতে একমাস সময় লাগবে। পিলারের রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কথা বলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিজাইনারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। ডিজাইনার এসে ফাটলের স্থানটি দেখবে। যে স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে তা মেরামত করে র্যাম্পটি দিয়ে গাড়ি চলাচল চালু করা যায় সেই ব্যবস্থা করা হবে। এটা ঠিক করা যাবে। ওপর থেকে ভেঙে পড়ে নাই। যে প্রতিষ্ঠান র্যাম্পের কাজ করছে তাকে বলা হবে রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করে দেওয়ার জন্য। আর তখন কাজটি করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স।’
র্যাম্প নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের টাকা ব্যয় হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, এক ডোনারের অর্থায়নে র্যাম্পটি নির্মাণ করা হয়েছে। কাজটি তত্ত্বাবধানে ছিল সিডিএ। তবে কারা টাকা দিয়েছিল, কত টাকা খরচ হয়েছে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি তিনি।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মোড়ে ফ্লাইওভারের পিলারের ফাটল পরিদর্শনে করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘উড়াল সড়কের (ফ্লাইওভার) নির্মাণ ত্রুটির কারণে র্যাম্পের দুটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। ত্রুটির কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ‘পিলারে ফাটলের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আমরা আজকেই সিডিএকে চিঠি দেব। কারণ যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেভাবে ফাটলটা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে হতবাক হয়েছি। এই ফ্লাইওভারে আগেও গার্ডার ধসে দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে সময় কয়েকজন মারা গিয়েছিল।
এদিকে সরেজমিন বহদ্দারহাট মোড়ের র্যাম্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুটি পিলারের ওপরের অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। মূলত পিলারগুলোর চারপাশেই ফাটল দৃশ্যমান। যে কারণে ফ্লাইওভারের ওপরের অংশ দিয়ে কালুরঘাটমুখী সবধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইদিকে ফ্লাইওভারের কালুরঘাটমুখী র্যাম্প দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার কারণে নিচের সড়কে যানবাহনের তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের উপরে কালুরঘাটমুখী র্যাম্পে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পিলারে ফাটলের খবর শুনে সোমবার (২৫ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টায় পুলিশ ওই স্থানে প্রতিবন্ধক বসিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এতে করে যেসব যানবাহন না জেনে ফ্লাইওভারের ওপরে উঠছে তাদের আবার ঘুরে গন্তব্যে যেতে হয়েছে।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাঈনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারের বহদ্দারহাট মোড়ের ওয়াই জংশন থেকে একটি অংশ গেছে কালুরঘাটের দিকে। কালুরঘাটের দিকে নামার অংশের একটি পিলারে ফাটল দেখতে পেয়েছি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই র্যাম্প দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ফ্লাইওভার দিয়ে এক কিলোমিটার যাওয়ার অংশে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক আছে। তবে এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের র্যাম্প বন্ধ থাকায় কালুরঘাট থেকে আসা গাড়িগুলো ফ্লাইওভারে উঠতে পারছে না।’
পুলিশ বলছে, হঠাৎ করে ওই এলাকার সড়কে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ পড়ায় কিছুটা যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
কাদের খান নামে এক পথচারী বলেন, কাজের ত্রুটি না থাকলে পিলারে ফাটল দেখা দিতো না। সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি জরুরি ভিত্তিতে এ ত্রুটি সমাধান করার জন্য।
ফুটপাতে মাস্ক বিক্রেতা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমি কয়েকদিন আগে থেকে এ পিলারে ফাটল দেখছি। তবে গতকাল ফাটলটা বেড়ে গেছে বলে মন
হচ্ছে।
কেএম/এসএম