পিকে হালদারের আরও দুই সহযোগী গ্রেপ্তার
অর্থআত্মসাৎ ও পাচারসহ বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আরও দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গ্রেপ্তাররা হলেন- পিপলস লিজিংয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক। রোববার (২৪ জানুয়ারি) বিকেলে সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান তাদের গ্রেপ্তার করেন। রাতে তাদেরকে রমনা থানায় রাখা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান বলেন, ‘গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।’
গ্রেপ্তারদের বিষয়ে জানা যায়, উজ্জ্বল কুমার নন্দী ২০১০ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসির কোম্পানি সচিব ছিলেন। ২০১৩ সালের অক্টোবরে তাকে এফএএস ফাইন্যান্সের পরিচালক করেন পি কে হালদার। এরপর তাকে আনন কেমিক্যাল ও পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান করা হয়। একইসঙ্গে উজ্জ্বল নন্দীকে নর্দান জুট, রহমান কেমিক্যাল, ক্লিউইস্টন ফুডের চেয়ারম্যানের পদ দেন পি কে হালদার।
রাশেদুল হক মূলত পি কে হালদারের ডান হাত ছিলেন। ২০১০ সালে পি কে হালদার যখন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন তখন রাশেদুল হক রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন। পি কে হালদার যখন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হন তখন রাশেদুল হক ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হিসেবে ২০১৫ সালে যোগদান করেন। এমডি হিসেবে যোগ দিয়েই সব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন রাশেদুল।
কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ প্রস্তাবের পরদিনই ঋণ দিয়ে দেন। এভাবে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানকে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মরগেজ (বন্ধক) ছিল না। কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে বন্ধক ছাড়াই শত শত কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে পথে বসিয়েছেন রাশেদুল।
পি কে হালদারের জালিয়াতির মামলায় বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) আরও দুই সহযোগী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সেদিন দুপুর সোয়া ১টায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা কমিশনের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন তাদের গ্রেপ্তার করেন। পরবর্তীতে তাদের আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাইলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়।
এই সুকুমার মৃধা পি কে হালদারের আয়কর সম্পর্কিত আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। তার মেয়ে অনিন্দিতা উইন্টেল ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক।
সুকুমার মৃধার দখলে প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পদ এবং তার মেয়ে অনিন্দিতার দখলে প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের সচিব মুহা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘পি কে হালদার বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর তার অবৈধ সম্পদ দেখাশোনা করতেন সুমুকার মৃধা ও অনিন্দিতা মৃধা। পি কে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান সুকুমার মৃধার তত্ত্বাবধান করেন।’
এর আগে, ১৩ জানুয়ারি পি কে হালদারের আরেক সহযোগী অবন্তীকা বড়ালকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। তারও রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় এর আগে গত ৪ জানুয়ারি পি কে হালদারের আরেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী শঙ্খ ব্যাপারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
শঙ্খ ব্যাপারীর নামে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া যায়, যা পি কে হালদারের অর্থায়নে কেনা হয়েছে বলে দুদকের এক কর্মকর্তা জানান।
আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি দুদক তার বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
অভিযোগ রয়েছে পি কে হালদার ওই প্রতিষ্ঠানসহ পিপলস লিজিং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) দায়িত্ব পালন করে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন।
ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের পরপরই প্রশান্ত কুমার হালদারের নাম উঠে আসে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর হাজির হতে নোটিশ দিয়েছিল সংস্থাটি। ৩ অক্টোবর পি কে হালদারের বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঠিকই দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। পরে দেশে আসার কথা বলেও আর আসেননি। এরই মধ্যে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে গ্রেপ্তার পরোয়ানা দিয়ে রেড এলার্ট জারি করেছে ইন্টারপোল।
পিকে হালদারের প্রতারণায় সহায়তাকারী ২৪ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। আর এখন পর্যন্ত তার সহযোগী হিসেবে ৬২ জনকে শনাক্ত করেছে দুদক।
আরএম/এফআর