ডিসেম্বরে আলোর মুখ দেখবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’?
জনাকীর্ণ শহর রাজধানী ঢাকা। দিন দিন বাড়ছে মানুষ। তাদের চলাচলের জন্য যেমন-তেমনভাবে বাড়ছে গণপরিবহন। তবে সেখানে নেই কোনো শৃঙ্খলা। রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরুর কথা ছিল। পরে সেটি পিছিয়ে সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এরপরও রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কমিটি। সর্বশেষ ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ কমিটির ১৮তম সভা শেষে আগামী ১ ডিসেম্বর নতুন তারিখ নির্ধারণ হয়।
নির্ধারিত নতুন তারিখে কি আলোর মুখ দেখবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’— এমন প্রশ্ন যানজটে নাকাল হওয়া নগরবাসীর।
গত ৫ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ১৮তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ঘোষণা দেওয়া হয় যে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামের বাস রুট রেশনালাইজেশনের প্রথম ধাপ। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত চলবে এ পরিবহন। প্রায় ২১ কিলোমিটারের এ রুটে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া পড়বে দুই টাকা ২০ পয়সা।
যে পরিকল্পনা নিয়ে চালু হচ্ছে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’
ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর— এ পাইলটিং রুটে নতুন নিয়মে, নতুন পদ্ধতিতে বাস চলবে। নতুন বাসের মাধ্যমে জনগণকে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে পুরনো কোনো বাস চলবে না। এখন এ রুটে যে বাসগুলো চলছে, সেগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারির পর কেনা বাস থাকবে। বাকি বাস উঠিয়ে নেওয়া হবে। এর সঙ্গে নতুন বাস যোগ হবে। সবমিলিয়ে এ রুটে ১২০টি নতুন বাস চলাচল করবে। এ প্রস্তাবনায় পরিবহন মালিকসহ সবাই সম্মতি জানিয়েছেন।
এ রুটে চলাচলকারী পরিবহনের চালক ও হেলপারের একটি নির্দিষ্ট পোশাক থাকবে। আগামী ২০ অক্টোবর এ রুটে চলাচলকারী বাসের ডিজাইন চূড়ান্ত করা হবে। পর্যায়ক্রমে ঢাকা শহরের বাকি গণপরিবহনেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে।
নতুন এ রুটে ৪০টির বেশি যাত্রী ছাউনি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে কমিটি। পাশাপাশি বাস-বে হবে ১৬টি স্থানে। জায়গা সংকটের কারণে বাস-বের সংখ্যা আর বাড়াতে পারছে না কমিটি। এ রুটে চলাচলকারী বাসগুলো নির্দিষ্ট রঙের হবে। রঙ নির্ধারণের বিষয়টি আগামী ১৪ অক্টোবরের মধ্যে কমিটিকে জানাবে পরিবহন-সংশ্লিষ্টরা। আগামী ২০ অক্টোবর বাসের রঙ চূড়ান্ত করা হবে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
‘ঢাকা নগর পরিবহন’ চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি এর আগেও এ রুটে বাস চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। এবারও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা সার্ভিসটি চালু করতে পারে কি না, তা-ই দেখার বিষয়। এটি চালু হলে সাধারণ যাত্রীসহ সবাই অনেক উপকৃত হবেন।
‘তবে বাস রুট রেশনালাইজেশন চালু করতে হলে আগে রোড সার্ভেটা ভালোভাবে করতে হবে। বর্তমানে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো অপসারণ করে তবেই পথে নামতে হবে। একজন যাত্রী যেন বাসের জন্য অপেক্ষা করার পর সময়মতো তা পান, এটি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো বাস এ রুটে চলতে দেওয়া যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, বারবার আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে হোঁচট খেয়েছি। শুল্ক প্রত্যাহার করে যখন ঢাকা শহরে ট্যাক্সি ক্যাব নামানো হলো তখনও আমরা বলেছি, আমাদের আশপাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করে ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু তখন এ বিষয়ে নজর দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে অনেকটা ব্যর্থ হয় এ উদ্যোগ।
‘এখানেও যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে এ সেবা স্থায়ী হবে না। তাই সবদিক বিবেচনা করে বাস রুট রেশনালাইজেশনের বিষয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে নিতে হবে। এছাড়া যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো আগেই সমাধান করে নিতে হবে’— বলেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব।
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘সাধারণ নাগরিক পরিষদ’-এর আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় মোট ১২০টি নতুন বাস নিয়ে যাত্রা শুরুর বিষয়টি আসলেই প্রশংসার দাবিদার। এমন ঘোষণা এর আগেও আমরা শুনেছি। তবে বিভিন্ন কারণে এটি বাস্তবায়ন হয়নি। এবার ডিসেম্বরে চালু হওয়ার যে ঘোষণা এসেছে, আমরা আনন্দিত।
‘সেবাটি চালু হলেও যদি রাজধানীর যানজট নিরসনে আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে এটি খুব একটা কাজে আসবে না। তাই বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় এ রুটে নতুন পদ্ধতিতে বাস নামানোর পাশাপাশি রাজধানীর বাকি অংশের যানজটের দিকেও নজর দিতে হবে।’
গত ৫ অক্টোবর বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ১৮তম সভা শেষে এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, দায়িত্বভার গ্রহণের পর গত বছরের ৬ অক্টোবর আমাদের প্রথম সভা (কমিটির ১২তম সভা) অনুষ্ঠিত হয়। করোনা মহামারির মধ্যেও আমরা পুরোদমে কাজ করছি। যেটা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ছিল, যেটা অত্যন্ত জটিল ছিল তা আমরা সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছেছি। আজ আমরা একটি চূড়ান্ত তারিখ দিতে পারছি। ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর, এ পাইলটিং রুটে নতুন নিয়মে, নতুন পদ্ধতিতে বাস চলবে। নতুন বাসের মাধ্যমে জনগণকে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এখনও যে সময় আছে, এর মধ্যে বাকি কার্যক্রম শেষ করে ১ ডিসেম্বর আমরা নতুন এ উদ্যোগের শুভ উদ্বোধন করব। এ রুটে কার্যক্রম শুরুর পর পর্যায়ক্রমে এ ক্লাস্টারের বাকি যে পথগুলো আছে, সেগুলোর কার্যক্রমও শুরু করব।
বাস রুট রেশনালাইজেশনের রূপরেখা
রাজধানী ঢাকার জন্য বাস রুট রেশনালাইজেশন বা কোম্পানিভিত্তিক বাসসেবা প্রবর্তনের রূপরেখা তৈরি করেছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। যেখানে ৪২টি রুটে বাসগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে ২২টি বেসরকারি কোম্পানি। কোম্পানিগুলো গঠন করা হবে জয়েন্ট ভেঞ্চার পদ্ধতিতে। বিআরটিএ’র হিসাবে বর্তমানে রাজধানীর ২৯১টি রুটে চলাচল করা বাসের সংখ্যা নয় হাজার ২৭টি। ঢাকার জন্য কোম্পানিভিত্তিক বাস সেবা প্রবর্তনের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে তাতে বাসের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত হাজার ৩৩৫টি।
ডিটিসিএ সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিভিত্তিক বাসসেবা প্রবর্তনের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে- মেরুন ১, ২ নামে দুটি কোম্পানি গঠন করা হবে। ওই দুই কোম্পানির বাসগুলো হেমায়েতপুর, সদরঘাটের কয়েকটি রুটে চলাচল করবে। অরেঞ্জ ১, ২, ৩ নামের তিনটি কোম্পানির বাস চলবে মিরপুর, নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি রুটে। ব্লু ১, ২ নামে দুটি কোম্পানির বাস আব্দুল্লাহপুর, আজিমপুর, হেমায়েতপুরের কয়েকটি রুটে চলাচল করবে।
একইভাবে পিংক ১, ২, ৩ নামে গঠন করা হবে তিনটি কোম্পানি। যেগুলোর বাস আব্দুল্লাহপুর, ঝিলমিলের কয়েকটি রুটে চলাচল করবে। গ্রিন ১, ২, ৩ ও ৪ নামের চারটি কোম্পানির বাস চলবে ঘাটারচর, আব্দুল্লাহপুরের কয়েকটি রুটে। নর্থ ১, ২ নামে গঠন করা দুটি কোম্পানির বাস চলবে কালিয়াকৈর, আব্দুল্লাহপুরের কয়েকটি রুটে। নর্থওয়েস্ট ১, ২ নামের দুটি কোম্পানির বাস চলবে চন্দ্রা, হেমায়েতপুরের কয়েকটি রুটে। ভায়োলেট ১, ২ ও ৩ নামে কোম্পানির মাধ্যমে বাস চলবে কাঁচপুর, আব্দুল্লাহপুরের কয়েকটি রুটে। এছাড়া সাউথ ১ নামে অন্য এক কোম্পানির বাস মুন্সিগঞ্জ, ঝিলমিলের কয়েকটি রুটে চলাচল করবে।
নতুন কার্যক্রমে আর কী আছে
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি রাজধানীতে গণপরিবহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা দূর করতে গঠন করা হয়েছিল বাস রুট রেশনালাইজেশন সংক্রান্ত কমিটি। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ শুরুর পর করোনাকালে অনেকটাই থেমে যায় তাদের কাজের অগ্রগতি। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চক্রাকার বাস নামানো, নতুন রুট নির্ধারণ, বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজিং, আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের স্থান নির্ধারণসহ বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে তারা।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রমের বিষয়ে কমিটির অন্যতম সদস্য ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, করোনার জন্য আমাদের সার্বিক কার্যক্রম অনেকটা আটকে ছিল। সেভাবে আমরা মিটিংও করতে পারিনি। তবে আমাদের কার্যক্রম এখন ফের শুরু হয়েছে। বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের। এসব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি।
জানা গেছে, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল হিসেবে ঢাকা মহানগরীর শহরতলীর চারটি স্থান প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। স্থানগুলো হচ্ছে- বিরুলিয়ার বাটুলিয়া, সাভারের হেমায়েতপুর। অন্যদিকে তেঘরিয়া ও কাঁচপুর। বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির কাছে কারিগরি কমিটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও ডিপোর জন্য প্রস্তাবিত ১০টি স্থানের মধ্যে এ চারটি স্থান নির্ধারণ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই ধাপে এ বাস টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করা হবে।
এএসএস/এমএইচএস/এমএআর//