বিচ্ছেদের পরও দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে লিভ টুগেদার, অতঃপর
২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে সাথী আক্তারের সঙ্গে বগুড়ার জুবায়ের হোসেন শুভর (২৩) পরিচয়। অতঃপর প্রেম। প্রেম থেকে শুভ পরিণয়ের আশায় প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর জুবায়েরকে বিয়ে করেন সাথী। তবে মাস তিনেক না যেতেই তাদের মধ্যে শুরু হয় মনোমালিন্য। অবশেষে বিচ্ছেদ।
কিন্তু বিচ্ছেদের আট মাস পর পুনরায় রাজধানীর খিলক্ষেত দরজি বাড়ি এলাকার ক/২০৫/এইচ/২নং বাসায় একসঙ্গে বসবাস (লিভ টুগেদার) শুরু করেন জুবায়ের ও সাথী। অবৈধ সম্পর্কের এ সুখের সংসারও তাদের বেশি দিন টিকল না!
বিচ্ছেদের (ডিভোর্স) পরও প্রথম স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং টিকটক-লাইকিতে ভিডিও প্রচারসহ নানা কারণে পুনরায় তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। একপর্যায়ে মাত্র চার হাজার টাকা নিয়ে বিবাদের জেরে চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে সাথীকে হত্যা করেন জুবায়ের। বিষয়টি আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন তিনি
বিচ্ছেদের (ডিভোর্স) পরও প্রথম স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং টিকটক-লাইকিতে ভিডিও প্রচারসহ নানা কারণে পুনরায় তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। একপর্যায়ে মাত্র চার হাজার টাকা নিয়ে বিবাদের জেরে চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে সাথীকে হত্যা করেন জুবায়ের। বিষয়টি আত্মহত্যা বলে চালানোর জন্য মরদেহ বাথরুমের ভেন্টিলেটরের রডের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন। পরে সবজি কাটার বটি দিয়ে ওড়না কেটে এবং বাথরুমের দরজার ছিটকিনি ভেঙে মোবাইল ও নগদ অর্থসহ পালিয়ে যান জুবায়ের।
মাত্র ২০ দিনের মাথায় সাথী আক্তারের হত্যার রহস্য উদঘাটন প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে এমন তথ্য জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান।
তিনি জানান, ঘটনার পরম্পরা, আলামত ও সুরতহাল দেখে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাই ধাঁধাঁয় পড়ে যান। প্রাথমিকভাবে সবাই মনে করেন সাথী আক্তার আত্মহত্যা করেছেন। তবে জুবায়েরকে গ্রেফতারের পর স্পষ্ট হয় তিনি পরিকল্পিত হত্যার শিকার।
সাথী আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১৪ সেপ্টেম্বর। ১৬ সেপ্টেম্বর খিলক্ষেত থানায় নিহতের পরিবার হত্যা মামলা (মামলা নং- ১৮) দায়ের করেন। মামলায় দ্বিতীয় স্বামী জুবায়ের হোসেন শুভকে আসামি করে তাকে পলাতক দেখানো হয়।
গত ৩ সেপ্টেম্বর (রোববার) ভোরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার গাজী কালুসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ গুলশান বিভাগের এডিসি এস এম রেজাউল হকের নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের একটি দল জুবায়ের হোসেনকে গ্রেফতার করে। ওই দিন বিকেলে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তাকে সোপর্দ করা হয়। সেখানে তিনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এ প্রসঙ্গে ডিসি মো. মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মাসে (১৪ সেপ্টেম্বর) খিলক্ষেত থানা এলাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডটি এত নিখুঁতভাবে করা হয় যে আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই। জুবায়েরকে গ্রেফতারের পরও মনে হয়েছে তিনি (সাথী আক্তার) আত্মহত্যাই করেছেন। তবে, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে জুবায়ের শিকার করেন যে তিনি সাথীকে হত্যা করেছেন। আদালতেও তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন।
কেন হত্যার শিকার হন সাথী আক্তার
এ বিষয়ে মশিউর রহমান বলেন, সাথী আক্তারের প্রথম স্বামী সৌদি আরবে থাকেন। তার টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। থাকতেন ভাড়া বাসায়, ব্যবহার করতেন স্মার্টফোন। সেই ফোন দিয়ে ভিডিও বানিয়ে টিকটিক-লাইকিতে শেয়ার করতেন। ফেসবুকে বিচরণ করতে গিয়ে বগুড়ার ছেলে জুবায়েরের সঙ্গে পরিচয় হয় সাথীর। এরপর প্রেম ও বিয়ের সম্পর্কে জড়ান। প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে থাকা শুরু করেন চট্টগ্রামে। সেখানে তাদের মনোমালিন্য হলে গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় স্বামী জুবায়েরকেও ডিভোর্স দেন। চট্টগ্রাম থেকে বোনের বাড়ি রাজশাহীতে চলে যান সাথী আক্তার।
বিচ্ছেদের পরও এ সময় প্রথম স্বামীর টাকায় চলতেন সাথী আক্তার। রাজশাহীতে গিয়ে ফের দ্বিতীয় স্বামী জুবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বিচ্ছেদের আট মাস পর পুনরায় বিবাহ ছাড়াই একসঙ্গে (লিভ টুগেদার) বসবাসের জন্য রাজধানীর খিলক্ষেত দরজি বাড়ি এলাকার ক/২০৫/এইচ/২নং বাসা ভাড়া নেন এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন।
ঢাকায় আসার পরও তারা প্রথম স্বামীর টাকায় জীবনযাপন করছিলেন বলে জানান ডিসি মো. মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ফের বিয়ের জন্য চাপ দিলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন জুবায়ের— এমন ভয়ভীতি দেখান সাথী। জুবায়েরের সামনেই ভিডিও কলে প্রথম স্বামীর সঙ্গে কথা বলতেন। শুধু তা-ই নয়, বার বার নিষেধ করার পরও টিকটক-লাইকিতে ভিডিও শেয়ার করতেন সাথী। ফোনে কথা বলতেন একাধিক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে। সাথীর এমন আচরণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জুবায়ের তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
যেভাবে হত্যা করা হয় সাথীকে
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া প্রসঙ্গে এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পনা মোতাবেক গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে প্রথম স্বামীর দেওয়া চার হাজার টাকা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে পেছন থেকে সাথীর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
মশিউর রহমান বলেন, হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে সাথীর মরদেহ বিছানা থেকে টেনে-হিঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে যান জুবায়ের। এরপর বাথরুমের ভেন্টিলেটরের রডের সঙ্গে তাকে ঝুলিয়ে দেন। কিন্তু পা মেঝেতে লেগে যাওয়ায় জুবায়ের সবজি কাটার বটি দিয়ে ওড়না কেটে দেন। বাথরুমের দরজার ছিটকিনিও বটি দিয়ে ভেঙে ফেলেন। যাতে সবাই ধারণা করেন, সাথী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল এবং তিনি তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। পরে জুবায়ের মোবাইল ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যান।
এ বিষয়ে ডিএমপি’র গোয়েন্দা প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাথী আক্তার হত্যা মামলাটি তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন জুবায়ের। কারণ, জুবায়ের হত্যা করলেও পরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, এ হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছে টিকটক-লাইকিতে ভিডিও প্রচার, ভারতীয় সিরিয়াল দেখা এবং অবৈধ সম্পর্ক। এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে, যা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের একটি রূপমাত্র।
এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, প্রত্যেকটি পরিবারেরই সুস্থ বিনোদন প্রয়োজন। টিকটক-লাইকিসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্তি এবং অবৈধ সম্পর্কের মতো সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে আমাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। তা না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
জেইউ/এমএআর/