চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সড়কের ৮ কিমি জুড়ে বেহাল দশা
চট্টগ্রাম নগরী থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার সড়কটির বেহলা দশা। সড়কটির এ বেহাল দশা তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের কারণে।
চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়টির। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রকল্পের লক্ষ্য চট্টগ্রাম শহরের ভয়াবহ যানজট নিরসন।
তবে, এলিভেটেড এক্সপ্রসওয়ে নির্মাণ কাজ শুরুর পরই এই সড়কটি দিয়ে চলাচলকারীদের দুর্ভেগে পড়তে হয়। বৃষ্টি হলে ভাঙা রাস্তায় পানি জমে যায়। ফলে দুর্ঘটনায় আশঙ্কা মাথায় নিয়েই গাড়ি চলাচল করতে হচ্ছে। এছাড়া ভাঙা রাস্তার কারণে যানজটে পড়ে মানুষজনের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (সিডিএ) স্বীকার করছে নির্মাণাধীন ১৬ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৮ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল।
সড়কটির বেহাল অবস্থা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে সড়কটিতে কার্পেটিং করতে পারছি না। নভেম্বর মাসে গিয়ে পুরোপুরি কার্পেটিং এর কাজ শুরু করা হবে। বর্তমানে বড় বড় গর্ত ভরাট করে দিচ্ছি। আমরা একদিকে গর্ত ভরাট করছি, অপরদিকে গাড়ি চলাচলের ফলে আবার হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির কারণে পুরোপুরি কার্পেটিং করতে পারছি না।'
তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তাটির পাশে কোনো ড্রেন নেই। যে কারণে বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। সিটি করপোরেশন যে ড্রেন করছে সেগুলো অকেজো। আমরা বড় করে ড্রেন নির্মাণ করে দিচ্ছি। যাতে করে পানি জমে না থাকে।
তিনি বলেন, ‘১৬ কিলোমিটার ব্যাপী যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ করা হচ্ছে এরমধ্যে ৮ কিলোমিটারের মতো রাস্তার অবস্থা বেহাল। নভেম্বর শুরু হলে বেহাল রাস্তাটির কার্পেটিং করা হবে।’
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী আরও বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির ৫৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ হবে না। তাই কাজের মেয়াদ আরও একবছর বাড়ানো হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের ফলে চট্টগ্রামের শেখ মুজিব সড়কটির বর্তমান অবস্থা বেহাল। এছাড়া বিমানবন্দর ও পতেঙ্গা যাওয়ার সড়কটির সল্টগোলা ক্রসিং থেকে বন্দরটিলা এলাকা পর্যন্ত বেহাল অবস্থা। এসব এলাকায় দেখা গেছে একের পর এক গর্তে বৃষ্টির পানি জমে আছে। বৃষ্টি হলে কোথাও পিচ ঢালাইয়ের অস্তিত্বই থাকে না। গর্তে পানি জমে পরিণত হয় ছোট ডোবায়। এসব গর্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। এছাড়া ভাঙা রাস্তা, কাদা আর ধুলাবালির ভোগান্তি তো আছেই। সড়কটিতে যানজট সামলাতে ঘাম ছুঁটছে ট্রাফিক পুলিশের।
নগরবাসীর অভিযোগ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় সড়কটির এমন বেহাল দশা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণর কথা থাকলেও তারা তা করছে না। নির্মাণকাজ চলাকালে সড়কটির চার লেন নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তাও করেননি তারা।
এদিকে, বিমানবন্দর সড়কের সল্টগোলা ক্রসিং থেকে পতেঙ্গা সৈকত পর্যন্ত অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলায় নগরীর অন্যতম ব্যস্ত এ সড়কে যানজট এখন প্রতিদিনের ঘটনা। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাঙা রাস্তা, কাদা আর ধুলোবালির ভোগান্তি। পানি চলাচলে পর্যাপ্ত নালা না থাকায় বৃষ্টির সময় বিভিন্ন অংশে সড়কের ওপর দিয়ে রীতিমতো জলের ঢেউ বইতে শুরু করে। ফলে সড়কের নেভি হাসপাতাল গেট, বন্দর টিলা, নেভি কলেজ, ইপিজেড, সল্টগোলা ক্রসিংসহ বিভিন্ন অংশে ইতোমধ্যে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফতাবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিমানবন্দর সড়কের বর্তমান বেহাল অবস্থার জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না। যে কোনো উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রতিটি ধাপে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সতকর্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, যাতে মূল সড়কের স্বাভাবিক যান চলাচলে খুব বেশি বিঘ্ন না ঘটে। নির্মাণ কাজের ভারী যানবাহন চলাচলের ফলে মূল সড়কের মারাত্মক ক্ষতি না হওয়ার জন্য নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ অত্যাবশ্যকীয়, যা ওই কাজের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখ যায়নি। সর্বোপরি এ ধরনের প্রকল্পের কাজ শুরু হবার আগেই ভূমিসংক্রান্ত জটিলতার অবসান করতে হয়। অত্র প্রকল্পে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ভূমিসংক্রান্ত জটিলতার কারণে কাজের গতি শ্লথ হয়ে যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি অনেক বেড়ে যায়।’
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সড়কগুলোর বেহাল অবস্থার মূল কারণ হচ্ছে মহানগরীর উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট যে সংস্থাগুলো আছে বিশেষত সিডিএ, ওয়াসা এবং সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। দেখা যায়, কোনো একটি রাস্তা হয়ত সিটি করপোরেশন নতুন পিচ ঢালাই করে গেল, তার কিছুদিন পরেই ওয়াসা এসে পানির লাইনের জন্য সে রাস্তা কেটে ফেলল। এর ফলে ওই নতুন রাস্তার অবস্থা কিছুদিনের মধ্যেই খুব খারাপ হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে বারবার কাজ করার কারণে সরকারের অনেক অর্থের অপচয় হয়। অনেক সময়ই অদক্ষ ঠিকাদার এবং ত্রুটিপূর্ণ কাজের ধরনের জন্য (যেমন সঠিক তাপমাত্রা এবং যথাযথ বিটুমিনের মিশ্রনের নিশ্চিতকরণ) যথাযথ মাননিয়ন্ত্রণ করা হয় না। এর ফলে রাস্তার স্থায়িত্ব অনেকাংশেই কমে যায়। এছাড়াও সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ার কারণে জোয়ার ভাটার সময় অথবা বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির সময় শহরের অনেক রাস্তায় নিয়মিত ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে ওই রাস্তাগুলোর অনেক জায়গায় গর্তের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমাগত চলমান গাড়ির কারণে খুব অল্প সময়েই রাস্তার বেহাল অবস্থা হয়ে যায়।
বিমানবন্দর সড়কে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর, সিইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড, ছয়টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ সড়কে দিনে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০ হাজার যানবাহন আর কয়েক লাখ মানুষের চলাচল।
স্থানীয়রা জানান, সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত ইপিজেড কেন্দ্রিক যানবাহনের চাপ থাকে সর্বোচ্চ। বেলা বাড়ার সঙ্গে বন্দরগামী পণ্যবাহী ভারী যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ কারণে বেলা ১১টা থেকে শুরু হয় আবার যানজট। বিকেলে অফিস ছুটির পর থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত পুরো এলাকাজুড়ে যানজট লেগেই থাকে।
আগ্রাবাদ থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নিয়মিত যাতায়াত করেন ব্যাংক কর্মকর্তা কাজী সোবহান। তিনি বলেন, এ সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করা এখন অনেক কষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে সড়কটি ভাঙ্গা, অন্যদিকে যানজটের ভোগান্তি।
ইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আজহারুল ইসলাম বলেন, রাস্তা ভাঙার কারণে গাড়ি চলে ধীরে ধীরে। সবসময় জ্যাম থাকে। পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা সাহেদ করিম বলেন, রাস্তা ভাঙা, বৃষ্টি হলে কাদাপানি আর রোদ উঠলে ধুলো উড়ে সারাদিন।
বাসচালক আবদুল মজিদ বলেন, এখন আমাদের কাছে চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিমানবন্দর সড়কটি। বিশেষ করে সল্টগোলা থেকে বন্দরটিলা অংশ যেন আজাব। এইখানে নির্মাণকাজের জন্য সড়ক এমনিতেই সরু, তার ওপর বৃষ্টি হলে সেই সরু অংশেও পানি জমে যায়। ভাঙা সড়কের কারণে প্রায় গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে।
কেএম/এসএম