‘প্ররোচনা’ সত্ত্বেও ইভানার মৃত্যুকে আত্মহত্যাই বলছে পুলিশ
দুই ভবনের মাঝে পড়েছিল ইভানা লায়লা চৌধুরীর (৩২) মরদেহ। রাজধানীর ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্কলাসটিকার ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত এই উচ্চশিক্ষিত নারীর মৃত্যুকে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের পক্ষ থেকে রহস্যজনক হিসেবে দাবি করলেও আত্মহত্যাই বলছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, ইভানার মৃত্যুকে রহস্যজনক দাবি করা হলেও উদ্ধার করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বলছে ইভানা ছাদে উঠে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। যদিও আত্মহত্যার নেপথ্যে অন্য কারও ইন্ধন, সহযোগিতা বা প্ররোচনা ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে। এজন্য পুলিশ ময়না তদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষায়।
ইভানার স্বজনদের দাবি, তার স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান ওরফে রুম্মানের আচরণ সন্দেহজনক। বিয়ের পর থেকেই তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। প্ররোচনা দিয়ে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছে যা হত্যার সামিল। ঘটনার দিনও ঝগড়া হয়েছে। তার আগের দিনও ঝগড়ার সূত্র ধরে নিজের হাত নিজেই কেটেছিলেন ইভানা।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর বেলা পৌনে ৪টার দিকে ৯৯৯ এর মাধ্যমে খবর পেয়ে নবাব হাবিবুল্লাহ রোডের সাকুরা গলিতে দুই ভবনের মাঝখান থেকে ইভানার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার জানান, ‘পরীবাগে নবাব হাবিবুল্লা রোডের ২/ক/১৪ নম্বর ৯ তলা ভবনের ৫ম তলায় থাকতেন ইভানা। আমরা ঘটনাস্থলের একটি সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। সেখানে দেখা গেছে, ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ছেন ওই নারী। ওই দিন রাতেই শাহবাগ থানায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন চাচাতো ভাই এএসএম মাহাবুব উল্লাহ চৌধুরী।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ইভানার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ইভানার শ্বশুর ইসমাইল হোসেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। নিহতের স্বামী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ইভানার সঙ্গে রুম্মানের ২০১১ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। সংসারে এই দম্পতির দুটি ছেলে রয়েছে। ইভানা উত্তরা ও মিরপুর শাখার স্কলাস্টিকা স্কুলের ইউনিভার্সিটি প্লেসমেন্ট সার্ভিসের প্রধান ছিলেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী ও ইভানাকে গুরুতর জখম অবস্থায় উদ্ধারকারী শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্বাস আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অপমৃত্যুর মামলার সূত্র ধরেই তদন্ত চলছে। আপাতত ভিডিও ফুটেজ বলছে, ওই নারী আত্মহত্যাই করেছেন। তবে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছি। পাশাপাশি স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য, স্বামীর পরকীয়াসহ নানা বিষয়ে উঠা অভিযোগও আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
ঘটনার পর ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক।
অনেক চেষ্টার পর নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নিরাপত্তা রক্ষী বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে খুব একটা বের হতে দেখা যেত না ওই নারীকে। বেশিরভাগ সময়ই তাকে চুপচাপ দেখা যেত। গত ১৫ সেপ্টেম্বর যখন ঘটনা ঘটে, তখন আমি ডিউটিতে ছিলাম না। পরে শুনেছি ওই নারী ৯ তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কেউ একজন ৯৯৯ কল সেন্টারে ফোন করে ঘটনাটি পুলিশকে জানায়।’
তিনি বলেন, ‘ইভানা তার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় থাকতেন। এই মুহূর্তে ওই বাসায় কেউ নেই।’
ইভানার এক সহকর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইভানার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের খাতিরে অনেক কথাই কানে আসতো। ইভানাকে মানসিকভাবে দুর্বল ভেঙে পড়েছিল। স্বামী রুম্মানের অন্য এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে তিনি ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। পারিবারিক কলহ চলছিল।’
তিনি বলেন, ‘শুনতাম ইভানাকে মাঝেমধ্যেই শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। রুম্মানের পরিবার জেনেও শ্বশুর-শাশুড়ি কেউ প্রতিকারে উদ্যোগ নেয়নি।’
রুম্মানের ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো ইভানার। ইভানার মৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শ্বশুরবাড়িতে ইভানা বউ হিসেবে স্বাভাবিক আচরণ পেতেন না। পরকীয়া প্রসঙ্গ ফাঁস হওয়ার পর এমন কথাও শুনতে হয়েছে ইভানাকে যে, রুম্মান আরেকটি বিয়ে করলে তোমার ক্ষতি কোথায়? সে ব্যারিস্টার। ছেলে মানুষ বাইরে কারও সঙ্গে মিশতেই পারে।’
ইভানার বাবা আমান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ইভানা ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের এক্সটার্নাল স্টুডেন্ট হিসেবে ঢাকার কলাবাগানের এলসিএলএস (সাউথ) থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে। এরপর স্কলাস্টিকায় ফুলাটাইম চাকরি শুরু করে। বিয়ের পর বাধা দেয় স্বামী রুম্মান। যে কারণে বাধ্য হয়ে শেষের দিকে সে পার্টটাইম কাজ নিতে বাধ্য হয়।’
তিনি বলেন, ‘কিছু দিন আগে আমি জানতে পারি ইভানাকে মারধর করা হয়, মানসিক নির্যাতন তো ছিলই। রুম্মান আরেক বিবাহিত ব্যারিস্টার নারীর (নাম সানজানা ইয়াসিন খান) সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত। সে নিজে রুম্মানের ফোনে হোয়াটসঅ্যাপে সানজানার সঙ্গে প্রেমালাপের স্ক্রিনশর্ট নিয়ে দেখিয়েছে। এসব নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এক বছর ধরে ইভানা থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছিল। তার সঠিক চিকিৎসা না করিয়ে ইভানাকে গত ৬ এপ্রিল রুম্মানের পরিচিত ডাক্তার কিডনি স্পেশালিস্ট অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক মোল্লার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ইমপালস মেডিকেলে বসেন। ওই চিকিৎসক কোনো প্রকার ডায়াগনসিস ছাড়াই থাইরয়েড ও মানসিক চিকিৎসা শুরু করেন। লিখে দেন কিছু ওষুধ। ইভানা এসব ওষুধ নিয়মিত খেতো। ওই চিকিৎসার কারণে ইভানার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল।’
আক্ষেপ করে ইভানার বাবা বলেন, ‘ইভানার মৃত্যুর পর তার শ্বশুর, শাশুড়ি ও স্বামীর আচরণ ছিল অসামাজিক। তারা লাশের সঙ্গে হাসপাতালে যায়নি। মর্গেও যায়নি। জানাজা থেকে দাফন কোনো কাজে অংশ পর্যন্ত নেয়নি। ইভানার দুই সন্তান এখন কেমন আছে তার খোঁজও কেউ রাখেনি।’
স্বামীর পরকীয়ায় ইভানার হতাশা প্রকাশ পেয়েছে ফেসবুকেও
অন্য এক নারীর সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টের কমেন্টে নিজের হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন।
ইভানা লিখেছেন, ‘….আমার দ্বিতীয় সন্তান অটিজমের শিকার, তার বিকাশ ঘটেছে দেরিতে। আমার নাবালক সন্তানের চ্যালেঞ্জগুলো আমাকে ধৈর্যশীল করেছে, কিন্তু তার বাবার হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় আমার স্বামী একজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। ওই নারীর একটি ছেলে সন্তানও আছে।… জীবনটা একটি কঠিন জার্নি, বিয়ের ১০ বছর পর আমার উপলব্ধি হলো, সত্যিই নিশ্বাস নিতে পারা কষ্টকর। আমি সিঙ্গেল জীবন কাটাব তার জন্য প্রস্তুত নই। আমার দুই সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই। কেননা আমাদের সমাজ সবসময় ছেলেদের পক্ষে। আমি আজ এখানে লিখছি, এক মাস হাসিমুখে থাকার পরও আমি মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার ছোট সন্তান আমাকে মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরিয়ে আনছে। এই অবুঝ শিশুদের মধ্যে অদ্ভুত শক্তি রয়েছে!’
ইভানার মৃত্যুর বিষয়ে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করেও স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ইভানার বাবার মামলা নেয়নি পুলিশ
ইভানাকে প্ররোচনা দিয়ে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে আত্মহত্যার প্রকারান্তরে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ তুলে শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) শাহবাগ থানায় মামলার আবেদন করলেও তা গ্রহণ করেনি পুলিশ।
অপমৃত্যুর মামলার তদন্ত শেষে নতুন মামলা নেবে পুলিশ
এ ব্যাপারে রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইভানার মৃত্যুর বিষয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। সেটিকে ধরেই আমরা তদন্ত করছি। নতুন মামলার আবেদনের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। অপমৃত্যুর মামলাটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অপমৃত্যুর মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর নতুন মামলা রুজু হবে।
জেইউ/ওএফ