সাড়ে ১২ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্সের সমাধান সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠানে
প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারছে না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন না প্রায় সাড়ে ১২ লাখ গাড়িচালক। পদে পদে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ মোটরযান চালানোর অস্থায়ী অনুমতিপত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এ অবস্থায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেও কিছুটা বিরক্ত। গত ৮ সেপ্টেম্বর বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে মতবিনিময় সভায় তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে বিলম্ব তথা ধীরগতি আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। তাই কোনোভাবেই আর বিলম্ব করা যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ১২ লাখ স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাপার কাজ চলতি বছরের অক্টোবর থেকে শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিএ। তা শেষ হবে আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে। আর আগামী ছয় মাসের মধ্যে সাড়ে ১২ লাখ লাইসেন্স বিতরণ করবে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস সোমবার বিকেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সঙ্গে বিআরটিএ’র চুক্তি সই হয়েছে। আশা করছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পেন্ডিং সব কার্ড ছাপা শেষ হবে। তাতে আটকে থাকা ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এভাবে এ সংকটের সমাধান হবে বলে আমরা মনে করছি।
বিআরটিএ’র সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ১৫-২০ দিন পর থেকে স্মার্ট কার্ড ছাপার কাজ শুরু হচ্ছে। এজন্য বিএমটিএফ’র সঙ্গে বিআরটিএ’র চুক্তি হয়েছে। পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে পেন্ডিং সব ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, আগামী মাস অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড ছাপার কাজ শুরু করবে সেনাবাহিনী পরিচালিত বিএমটিএফ। ছাপার কাজ শুরুর ছয় মাসের মধ্যে আটকে থাকা ১২ লাখ ৪৫ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের কাজ শেষ করবে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন আবেদনের বিপরীতে লাইসেন্স দেওয়ার কাজ করবে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স।
আগে থেকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের জন্য বিআরটিএ’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দুদফায় সময় বাড়িয়ে নেয়।
পাঁচ বছরে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের ৪০ লাখ স্মার্ট কার্ড (স্মার্ট লাইসেন্স) সরবরাহের চুক্তি রয়েছে বিআরটিএ’র সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর মিরপুরে সেন্ট্রাল এনরোলমেন্ট স্টেশন স্থাপনের কাজ শেষ করতে পারেনি। প্রস্তুতিপর্বে চারটি জেলা থেকে লাইসেন্স সরবরাহের কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। তা-ও করতে পারেনি। ফলে বিদেশে চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে লাইসেন্স প্রার্থীদের। যথাসময়ে লাইসেন্স না পেয়ে অনেকে সড়কে পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ গাড়ি চালানোর পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
৮ সেপ্টেম্বরের মতবিনিময়ে এ বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন সড়কমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের। তিনি বলেন, করোনাকালে বিভিন্ন দেশে ফ্লাইট বন্ধ ছিল। কিন্তু এখন অনেক দেশেই ফ্লাইট চালু হয়েছে। ফলে ফের দেশ থেকে জনশক্তি রফতানিও শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় বিদেশগামী আবেদনকারীদের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে স্মার্ট লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। প্রথম পাঁচ বছর সরবরাহে সমস্যা হয়নি। এরপর থেকেই সংকট শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা প্রকট রূপ নেয়। শুরু থেকে স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করে আসছিল বিআরটিএ’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড। বিআরটিএ’র সঙ্গে কয়েক দফা চুক্তি হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির।
দেশে গাড়ি চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্বাভাবিক সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকে। সংকট ধীরে ধীরে বেড়ে যেতে থাকে। টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে বিআরটিএ’র চুক্তি শেষ হয় গত ২২ জুন। চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালের ২২ জুন পর্যন্ত থাকলেও বিপুল চাহিদার ফলে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সরবরাহ শেষ হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। টাইগার আইটির ১৫ লাখ স্মার্ট কার্ড গত ২২ জুনের মধ্যে দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১২ লাখ কার্ড বিতরণ শেষ করে।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের মধ্যবর্তী সংকট মোকাবিলার জন্য সতর্ক করে দিয়ে টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড সংকট সৃষ্টির এক বছর আগে থেকেই দফায় দফায় বিআরটিএ-কে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু বিআরটিএ যথাসময়ে উদ্যোগ নেয়নি বলে জানা গেছে। এক পর্যায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গভীর সংকট তৈরি হলে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমানকে পদ থেকে সরিয়ে দেয় সরকার।
উন্মুক্ত (আন্তর্জাতিক) দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার লক্ষ্যে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে বিআরটিএ চুক্তি করে।
সংকট সমাধানের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করা হলেও অতিরিক্ত ক্রয়াদেশ, দরপত্র/পুনঃদরপত্রের মাধ্যমে এ পণ্য ক্রয়ে আইনগত ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা দেখা দেয়। ফলে লাইসেন্স সরবরাহের অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে পারেনি বিআরটিএ।
ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন করে সব ধরনের পরীক্ষায় পাস করেও অধিকাংশ লাইসেন্স প্রত্যাশী দুই বছর ধরে অপেক্ষা করছেন। প্রয়োজনীয় ফি, ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ দেওয়ার পরও স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স তারা পাচ্ছেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে স্মার্ট কার্ড আকারে ড্রাইভিং লাইসেন্স না দিয়ে সাময়িক অনুমতিপত্র দেওয়া হচ্ছে।
বিআরটিএ থেকে বলা হচ্ছে, পুরনো প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড নতুন প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটিজ প্রিন্টার্সের কাছে গ্রাহকদের তথ্য হস্তান্তর করেনি। ফলে আগে থেকে আটকে পড়া প্রায় সাড়ে ১২ লাখ লাইসেন্স সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
বিআরটিএ বলছে, গত মে থেকে নতুন লাইসেন্সের আবেদনকারীদের স্মার্ট লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাত হাজারের বেশি স্মার্ট কার্ড (স্মার্ট লাইসেন্স) বিআরটিএ’র বিভিন্ন সার্কেল অফিসে পাঠানো হয়েছে। মিরপুর-১২ এ স্থাপিত সেন্ট্রাল এনরোলমেন্ট স্টেশনে ঢাকা মেট্রো সার্কেল-১, ২, ৩ ও ঢাকা জেলা সার্কেল এবং ডিভিশনাল ছয়টি সার্কেল অফিসসহ মোট ১৪টি অফিসের বায়োএনরোলমেন্টের পাইলটিং কার্যক্রম চলতি বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করেছে নতুন চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। গত ১৯ মে থেকে সরাসরি বায়োএনরোলমেন্ট কার্যক্রম শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
পিএসডি/আরএইচ