‘ডিজিটাল প্রতারণা করে ইভ্যালি’, থানায় জিডি
দেশের অন্যতম আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে যথাযথ সময়ে পণ্য না দেওয়ার অভিযোগে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন একজন গ্রাহক।
ওই গ্রাহক অভিযোগ করেন, ই-স্কুটার কেনার জন্য তিনি ইভ্যালিকে ৬১ হাজার ১৮০ টাকা দিয়েছেন। তিনি নির্ধারিত সময়ে স্কুটার পাননি। বেশ কয়েকবার ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকাও ফেরত পাননি।
মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) কদমতলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হারুন ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি সম্প্রতি রাজধানীর কদমতলী থানায় হওয়া এই জিডি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তদন্তের বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’
জিডিতে ওই গ্রাহক জানান, তিনি গত ২৬ মার্চ ইভ্যালি থেকে ৩৫ শতাংশ ছাড়ের অফারে স্পেশাল ই-স্কুটার অর্ডার করেন। স্কুটারটির বাজারমূল্য ছিল ৯৫ হাজার টাকা, ছাড়ে তাকে ৬১ হাজার ১৮০ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। ৪১ কার্যদিবসে ওই স্কুটারটি ডেলিভারি দেওয়ার কথা থাকলেও দ্বিগুণ সময় চলে গেলেও তিনি স্কুটারটি পাননি। এ বিষয়ে তিনি ইভ্যালিতে যোগাযোগ করলে তারা একটি ম্যাসেজে জানায়, ‘ডিলারের কাছে ই-স্কুটারটি নেই, তাই তারা এটি সরবরাহ করতে পারবে না।’
জিডিতে ওই গ্রাহক বলেছেন, ইভ্যালির ম্যাসেজ পেয়ে আমি সরাসরি ওয়ারীতে অবস্থিত ইভ্যালির ই-বাইক ডিলার মো. বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বাবুল জানান, তাদের কাছে প্রচুর স্কুটার মজুদ রয়েছে। তবে সময়মত টাকা পরিশোধ না করায় তারা ইভ্যালিকে স্কুটার সরবরাহ করছেন না।
নির্ধারিত সময়ে পণ্য না পেলে ইভ্যালি ৭ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলেছিল। তবে ৪ মাসেও গ্রাহককে টাকা ফেরত দেয়নি ইভ্যালি। এ বিষয়ে ১৬ জুন সর্বশেষ তিনি ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদফতরে মামলাও করেন।
জিডিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রাহক ইভ্যালির সঙ্গে পণ্য ডেলিভারি অথবা টাকা ফেরতের বিষয়ে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছেন। জবাবে তারা ‘দ্রুত পেয়ে যাবেন, সময় দিয়ে সাথে থাকুন’ ইত্যাদি বলছে। বাইকের জন্য ইভ্যালির নুহাদ নামে একজন কর্মকর্তাকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘এইসব আমার ব্যাপার না, সিসিতে (কাস্টমার কেয়ার) কল দেন।’ এ বিষয়ে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলকে ম্যাসেজ করলেও উত্তর মেলেনি।
ওই গ্রাহক বলেন, ইভ্যালি টাকা নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে ডিজিটাল প্রতারণা করছে। আমি চাই না আমার মতো কেউ ডিজিটাল প্রতারণার শিকার হোক।
এদিকে, ইভ্যালির বিরুদ্ধে ৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা হয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে। এর মধ্যে বেশিরভাগ অভিযোগই টাকা পরিশোধ করে দীর্ঘদিন পণ্য না পাওয়ার।
অধিদফতর জানায়, গত জুন পর্যন্ত চার হাজার ৯৩২টি অভিযোগ পড়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। গত জুলাইয়ে আরও পাঁচ শতাধিক অভিযোগ আসে। চলতি আগস্টেও অভিযোগ আসছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ইভ্যালির বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে গত জুন পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি করেছে অধিদফতর।
২০১৮ সালে যাত্রা শুরু হওয়া ইভ্যালি বাংলাদেশ ভিত্তিক ই-কমার্স প্লাটফর্ম। লোভনীয় ডিসকাউন্ট কিংবা ক্যাশব্যাকের অফার দেওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইভ্যালির নাম সর্বাগ্রে। স্বল্প সময়ে অনলাইন ক্রেতার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন গ্রাহক ভোগান্তি ও সমালোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে।
জানা গেছে, সাইক্লোন, লণ্ডভণ্ড, ১৫ নম্বর সতর্ক সংকেত এমন ভয়ংকর সব নামে লোভনীয় অফার দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানায় ইভ্যালি। ওই টোপে পা দিয়ে গ্রাহক পণ্যের জন্য টাকা দিয়ে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
এর আগে, ১৯ জুলাই ইভ্যালিকে চিঠি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জবাবে দায়-দেনার তথ্য ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ছয় মাস সময় চেয়ে গত ১ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির উত্তর দেয় ইভ্যালি।
ইভ্যালিকে দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছিল, গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে মোট ৪০৭ কোটি টাকা দায়ের বিপরীতে ইভ্যালির কাছে মাত্র ৬৫ কোটি টাকার চলতি সম্পদ কেন? বাকি টাকা ইভ্যালির কাছে থাকলে বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে, না থাকলে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এছাড়া ১৫ জুলাই পর্যন্ত গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে দায় এবং তা পরিশোধের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ব্যবসা শুরুর পর গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালি কত টাকা নিয়েছে, মার্চেন্টদের কত টাকা পরিশোধ করেছে এবং প্রশাসনিক ও অন্যান্য খাতে কত টাকা ব্যয় করেছে, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ জানাতে বলা হয় নোটিশে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সম্পদ ও দায়ের হিসাব জমা দিয়েছে ইভ্যালি। এতে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তার নিজের ব্র্যান্ড মূল্য ৪২৩ কোটি টাকা। গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল কোম্পানিকে দিয়েছেন। বাকি ৫৪৩ কোটি টাকা হচ্ছে কোম্পানিটির চলতি দায়।
ইভ্যালি জানিয়েছে, দায়ের বিপরীতে তাদের চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে স্থাবর সম্পত্তি দাঁড়ায় ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা থেকে স্থাবর সম্পত্তি ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বাদ দিলে বাকি থাকে ৪৩৯ কোটি টাকা, যাকে ইভ্যালি বলছে তার অস্থাবর সম্পত্তি।
বিবরণী মেলাতে ইভ্যালি দেখিয়েছে, অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা হচ্ছে তার ব্র্যান্ড মূল্য, আর ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হচ্ছে অদৃশ্যমান সম্পত্তি।
সব মিলিয়ে ইভ্যালির মোট দেনার পরিমাণ ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮২ টাকা। এই দেনার বিপরীতে তাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য মোট সম্পদ রয়েছে ৫৪৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮২ টাকা।
গত ১৭ জুলাই ইভ্যালির পেমেন্ট স্থগিত করে বিকাশ। ওই সময় বেশকিছু ব্যাংকও ইভ্যালির সঙ্গে তাদের ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন স্থগিত করে। এর মধ্যে ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, ইউসিবি ও সিটি ব্যাংক ছিল। এছাড়া ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেশকিছু পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাউচারের বিপরীতে পাওনা অর্থ পরিশোধ না করায় তারা বিক্রি বন্ধ করে দেয়। ইভ্যালির গিফট ভাউচারে কেনাকাটার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞপ্তিও দেয়।
তবে গত ১৭ আগস্ট ইভ্যালির পেমেন্ট চালু করেছে বিকাশ। এছাড়া ইউসিবি ব্যাংকের উপায়, এসএসএল কমার্স এবং ভিসা মাস্টার কার্ডেও ইভ্যালির পেমেন্ট করা যাচ্ছে।
এআর/এইচকে/জেএস