নিবন্ধনেও মিলছে না টিকা, সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে টিকায় মানুষের আগ্রহ এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কিন্তু টিকা স্বল্পতায় দেড় থেকে দুই মাস আগে নিবন্ধন করেও টিকা পাওয়া যাচ্ছে না।
যারা টিকা পাননি বা যাদের দ্বিতীয় ডোজ পেতে দেরি হচ্ছে, তাদের অনেকেই অনিশ্চয়তা ও হতাশায় ভিন্ন পথ অবলম্বনের চেষ্টা করছেন। আর এ সুযোগটি নিচ্ছে অসাধু একটি চক্র। দেশে টিকার ঘাটতি মোকাবিলা এবং নিবন্ধনকৃতদের দ্রুত টিকা দিতে যখন স্বাস্থ্য অধিদফতর হিমশিম খাচ্ছে, তখন রাজধানীর ক্লিনিক-ফার্মেসিতে টাকায় মিলছে সেই টিকা!
জানা গেছে, ৫ আগস্ট পর্যন্ত টিকার অপেক্ষায় ছিলেন প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ। এরপর ১৯ আগস্ট টিকার জন্য অপেক্ষাকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি। মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে টিকার জন্য অপেক্ষায় থাকা মানুষের সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। তাদের অনেকে এক-দেড় মাস আগে নিবন্ধন করেও টিকা নেওয়ার কোনো বার্তা পাননি।
রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। টিকা পেতে প্রায় একমাস আগে স্ত্রী আমেনা বেগমসহ পরিবারের পাঁচ জনের নিবন্ধন করেছিলেন। কিন্তু কবে টিকা পাবেন, সে বার্তা (এসএমএস) এখনো পাননি। শুধু শফিকুল ইসলাম নন, নিবন্ধনের দেড় মাস পার হলেও এসএমএসের অপেক্ষায় লাখো মানুষ।
এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুততম সময়ে টিকার সংকট কাটিয়ে মানুষকে টিকার আওতায় আনতে না পারলে দেশে টিকার জন্য নৈরাজ্য দেখা দিতে পারে। ফলে টিকা গ্রহীতাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি সরকারের টিকা কার্যক্রমে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলাও দিতে পারে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, একটি কেন্দ্রে টিকা দেওয়ার যে সক্ষমতা, তার চেয়ে এখন নিবন্ধন বেশি হচ্ছে। তাই এসএমএস পেতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার ‘দরিদ্র পরিবার সেবা’ নামে একটি ক্লিনিকে অবৈধভাবে করোনাভাইরাসের মডার্না টিকা দেওয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিজয়কৃষ্ণ তালুকদারকে (৩৭) আটক করে পুলিশ। এ সময় ক্লিনিকটি থেকে মডার্নার টিকার দুটি অ্যাম্পুল পাওয়া যায়। এছাড়া মডার্নার টিকার খালি বাক্স পাওয়া যায় ২২টি। সেগুলো জব্দ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা শুধু সংবাদমাধ্যম সূত্রে রাজধানীর একটি ক্লিনিকে টিকা বিক্রির খবর শুনেছি। এরকমভাবে আরও কতগুলো ক্লিনিক চুরি করে টিকা বিক্রি করছে, সে খবর আমাদের জানা নেই। জেলা পর্যায়ে সেই সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে।
নিয়মবহির্ভূত চুরির টিকা নেওয়াদের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা
নিয়মবহির্ভূত টিকা নেওয়াদের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, টিকা একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ও নির্দিষ্ট নিয়মে পরিবহন করতে হয়। এর ব্যত্যয় হলে টিকা কার্যকারিতা হারাতে পারে। এসব সুবিধা সব জায়গায় নেই। সেক্ষেত্রে চুরি করেও যদি টিকা বিক্রি করা হয়, তা কোনো কাজে আসবে না। বরং এর মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
তিনি বলেন, টিকা বিক্রি ঠেকাতে না পারলে একসময় দেখা যাবে টিকার বদলে পানি বা কম পরিমাণে টিকা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে। এতে টিকাগ্রহীতা একটা ফলস সিকিউরিটিতে ভুগবেন যে, তিনি টিকা নিয়েছেন। আসলে ওই টিকা তার কোনো কাজেই আসবে না।
তাই এভাবে টিকা বিক্রি ঠেকাতে এখন থেকেই কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ এ বিশেষজ্ঞের। একইসঙ্গে টিকার সরবরাহ, বিতরণ, পরিবহন ও প্রয়োগের প্রতিটি পর্যায়ে কঠোর মনিটর করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে নিবন্ধন করে টিকার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার জন। হাসপাতালের ছয়টি বুথে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেক পাচ্ছেন প্রথম ডোজের টিকা, বাকিরা দ্বিতীয় ডোজ। এ অবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি নিবন্ধন হওয়ায় নিবন্ধিত সবাইকে টিকা দিতে আট থেকে নয় মাস লেগে যেতে পারে।
নিবন্ধনের তালিকা দীর্ঘ হওয়ায় টিকা পেতে দেরি
সক্ষমতার চেয়ে নিবন্ধন বেশি হওয়ায় টিকার এসএমএস পেতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আপনারা জানেন, অনেক মানুষ এ মুহূর্তে টিকা পেতে নিবন্ধন করছেন। নিবন্ধনের লাইন যত দীর্ঘ হবে, আমাদেরও টিকার জন্য এসএমএস দিতে কিছুটা দেরি হবে।
তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই ধরুন, ছোট একটি কেন্দ্রে ১০ হাজার মানুষ নিবন্ধন করেছেন। এক্ষেত্রে সে কেন্দ্রটিতে যদি দেখা যায় আড়াইশ থেকে তিনশ মানুষকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে, তাহলে এখানে কী করার আছে? এখন যেহেতু মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, নিবন্ধনের তালিকা লম্বা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে এসএমএস দিতে কিছুটা দেরি হবে। এটাই স্বাভাবিক।
নিবন্ধনের দেড় মাসেও এসএমএস আসছে না, এ অবস্থায় করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান আরও বলেন, এ মুহূর্তে করণীয় একটিই। টিকার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া আর কিছুই করার নেই। আর নিবন্ধনের পরে এক থেকে দেড় মাস সময় যেতেই পারে। আপনি যদি খোঁজ নেন, তাহলে দেখতে পাবেন, রাজধানীর একেকটি কেন্দ্রে ২০ থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা কী করবে? তাদের যে সক্ষমতা আছে, সে অনুযায়ী তাদেরকে কাজ করতে হবে। আমরা তো নতুন করে তাদেরকে জনবল বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করতে পারছি না।
গণটিকাদান নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা এলে অবশ্যই আপনাদেরকে জানানো হবে।
সরকারি টিকা চুরির বিষয়ে এমআইএস পরিচালক আরও বলেন, ফার্মেসি বা ক্লিনিকে করোনার টিকা পাওয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি। এই ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর পেছনে কে বা কারা জড়িত এমনকি কীভাবে ক্লিনিকে এ টিকা গেল, বিষয়টি জানতে হবে। আপনারা (মিডিয়া) আপনাদের অবস্থান থেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন, আমরাও দেখছি।
হাসপাতাল থেকে টিকা সরিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যে নিয়মে হাসপাতালগুলোতে টিকা পৌঁছে দিই, সেখান থেকে মিসিং হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কীভাবে কী হলো, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। হতে পারে কোনো হাসপাতাল থেকে, আবার হতে পারে টিকার মজুতকেন্দ্র থেকে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন আসার আগ পর্যন্ত এটি নিয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই।
দক্ষিণখানে যেভাবে টিকা চুরি হয়েছিল
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তরখান কলেজিয়েট স্কুলের কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন অভিযুক্ত বিজয় কৃষ্ণ তালুকার। টিকা দেওয়ার দায়িত্বে ছিল দরিদ্র পরিবার সেবা সংস্থা ক্লিনিক। এর মালিক বিজয় নিজে।
ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জয়নাল আবেদিন বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি এলাকায় বাবু নামে পরিচিত। গণটিকার ক্যাম্পেইন চলার সময় প্রতিদিন ৩৫০ জনকে টিকা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তিনি ২৫টি করে মডার্নার ভায়াল তার কেন্দ্রে নিতেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে ৫-৭ ডোজ কম হতো। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ভায়ালে ১৪ জনকে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও বিজয় সব সময় কমবেশি করতেন। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত থাকা ডোজগুলো রেখে কৌশলে বিক্রি করে দিতেন।
এ বিষয়ে দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি, রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার দরিদ্র পরিবার সেবা নামে একটি ক্লিনিকে অবৈধভাবে মডার্না টিকা দেওয়া হচ্ছে। সে অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার সন্ধ্যায় ক্লিনিকটিতে অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে গিয়ে দেখি, ক্লিনিকে দুজন টিকা নিচ্ছেন। পরে সরকারি নীতিমালা ছাড়া অবৈধভাবে করোনার টিকা দেওয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি মালিক বিজয়কৃষ্ণ তালুকদারকে (৩৭) আটক করি। এ সময় ক্লিনিকটি থেকে মডার্নার টিকার দুটি অ্যাম্পুল পাওয়া যায়। এছাড়া মডার্নার টিকার খালি বাক্স পাওয়া যায় ২২টি। সেগুলো জব্দ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আসার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) নিজস্ব সংক্ষরণাগারে কঠোর নিরাপত্তায় সংরক্ষণে রাখা হয়। সেখান থেকে বরাদ্দ অনুযায়ী টিকাকেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়।
করোনার টিকা কীভাবে ক্লিনিকে গেল, জানতে চাইলে ইপিআইয়ের ব্যবস্থাপক ডা. মওলা বক্স চৌধুরী বলেন, কীভাবে এ টিকা গেল, তা এখনও বলতে পারছি না। আমরা অবশ্যই এটি নিয়ে তদন্ত করব। ঘটনার সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দেশে সোয়া ২ কোটি ডোজ করোনা টিকা দেওয়া হয়েছে
বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত করোনা টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন তিন কোটি ৩৯ লাখ ৩১ হাজার ৯৩৪ জন। তাদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৬ জন এবং পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৬১৮ জন নিবন্ধন করেন। দেশে এ পর্যন্ত ২ কোটি ২৪ লাখ ১৩ হাজার ৭৯ ডোজ করোনা টিকার প্রয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১ কোটি ৬১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৭৭ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৬২ লাখ ৫৪ হাজার ৪০২ জন।
দেশে এ পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৬২ হাজার ১১৩ ডোজ। চীনের সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হয়েছে ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ৬৫০ ডোজ। এছাড়া, ফাইজার-বায়োএনটেকের ৯৩ হাজার ১৩৮ আর মডার্নার ২৭ লাখ ১৭ হাজার ১৭৮ ডোজ দেওয়া হয়েছে।
টিআই/আরএইচ