বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এখনও অসম্পূর্ণ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বিচার এখনও অসম্পূর্ণ। জঘন্য এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তার বিচার হলেও পেছনের পরিকল্পনাকারীদের বিষয়ে কোনোকিছু পরিষ্কার হয়নি। এমনটিই মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো কী ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছিল, সে রিপোর্টে কাদের নাম এসেছিল, সেগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আপাত দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। হত্যাকারীদের কারও কারও শাস্তি হয়েছে। কেউ কেউ পালিয়ে আছে। এই যে একটা পরিস্থিতি, এতে সন্তুষ্টির কিছু নেই। জাতি হিসেবে এটা হলো আমাদের দায়িত্ব পালন। বঙ্গবন্ধু জাতির জনক। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ড সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়। সপরিবারে একজন জাতির জনককে হত্যা করা হয়েছে। যিনি সেই সময় সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান। অতএব এখানে বিচার হওয়াটা, শাস্তি হওয়াটা সাংবিধানিক বিধান। এ দায়িত্ব আমরা বহুদিন পালন করতে পারিনি। সাংবিধানিক অর্ডিন্যান্স জারি করে কলঙ্কিত করা হয়েছিল। সেখান থেকে মুক্ত হয়ে একটি পরিস্থিতিতে আমরা এসেছি। এটি সন্তুষ্টির বিষয় নয়। বিষয়টি দায়িত্ব পালনের।’
তিনি বলেন, ‘আমি এটাও মনে করি, ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনের পুরো ষড়যন্ত্রটাকে উন্মোচন করা দরকার। সেই জায়গায় আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। একজন রাষ্ট্রপ্রধান, একজন সরকারপ্রধানকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্র উন্মোচনের জন্য একটি কমিশন গঠন হওয়া দরকার। সেটিও আমরা করতে পারিনি সময়মতো। এখন দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। ষড়যন্ত্রকারীদের অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন কমিশন অনেক কিছুই হয়তো করতে পারবে না। তারপরও কমিশন গঠন করা দরকার।
‘অনেকেই হয়তো পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্রের জাল রয়ে গেছে, সেটা তো বের করা যাবে। ওই জায়গাগুলোতে আবার রি-ভিজিট করা দরকার। একজন জনপ্রিয় নেতা যিনি দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার হত্যার পেছনে কে, কীভাবে সহযোগিতা করেছে অথবা কার, কী ভূমিকা ছিল- জাতির কাছে তা উন্মুক্ত হওয়া দরকার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য আরও বলেন, ‘এমনও হতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অথবা হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে এমন কিছু কাজ করেছেন, যেগুলো গর্হিত অপরাধ। কিন্তু তার হয়তো এখানে কোনো উপায় ছিল না। তাকে হয়তো উপর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাও ঘটতে পারে। হত্যাকারীদের অনেকেই বিদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাদের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়েছিল। নিশ্চয়ই কোনো কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা কি স্বেচ্ছায় করেছিলেন, নাকি আদিষ্ট হয়ে করেছিলেন- সার্বিক বিষয়গুলো আজ তুলে ধরা দরকার। যেমন- এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পরে কমিশন হয়েছিল। সেই কমিশনের রিপোর্ট এখন সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে এবং এর বিচার হওয়ার সময় বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন কেউ কেউ, কোনো কোনো গণমাধ্যম। এই যে বিষয়গুলো এগুলো কিন্তু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’
‘২০২১ সালে এসেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কিছু কিছু মানুষ নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা এর প্রকৃত উদাহরণ। এখানে শেখ হাসিনাকে দলের শীর্ষ নেতাসহ হত্যার পরিকল্পনা করা হলো। অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে শেষ করে দাও। এই যে কাণ্ডগুলো, এগুলো কিন্তু ষড়যন্ত্রের অংশ। একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে সার্বিক বিষয়গুলো দেখতে হবে। যারা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে যে দণ্ড হয়েছে তা কার্যকর করা, এগুলো জনগণের প্রত্যাশা। আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও গবেষণা করা দরকার। কারণ, বিচারের ক্ষেত্রে আপাতত যা হয়েছে, তা হলো সামরিক বাহিনীর যে কয়জন সদস্য সরাসরি জড়িত ছিলেন, তারাই কেবল বিচারের আওতায় এসেছেন, সাজা পেয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা শুধু কয়েকজন সামরিক বাহিনীর সদস্য করেছেন, এটা বলা বা চিন্তা করাটা খুব ডিফিকাল্ট।’
তিনি বলেন, ‘যে রাজনীতিবিদরা উৎসাহ দিয়েছেন, এমনকি আমরা বিদেশি কথাবার্তা শুনি যে, বেশ কয়েকটি দেশ বা তাদের ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন, সেগুলো বড় আকারে এখনও পরিষ্কার হয়নি। তবে অন্য যারা জড়িত, ভবিষ্যতে তাদের বিচার করা যাবে কি না, তা আমার জানা নেই। সেটা হয়তো অন্য বিষয়, কিন্তু এ ব্যাপারে আরও গবেষণা করা উচিত। প্রতিটি দেশেরই বড় ধরনের ইন্টেলিজেন্স থাকে। সেই ইন্টেলিজেন্স ডাটা দেখা দরকার। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে শুরু করে, আমেরিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন যে বড় দেশ ছিল, তাদের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো কী ধরনের ইন্ডিকেশন দিয়েছিল এবং কাদের নামগুলো আসছিল সেগুলো আসলে দেখা দরকার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় যে, ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর হয়েছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই ফেইলিওরটা কেন হলো? এ ধরনের একটা ন্যক্কারজনক তৎপরতা হতে যাচ্ছে, একটা ঘটনা ঘটছে, তা কেউ জানে না। বড় একটি রাজনৈতিক দলের একাধিক ব্যক্তি জানেন না। আমরা পরে দেখলাম মোশতাক নিজেই জড়িত। তাই এসব অনেক প্রশ্নের সমাধানে আমার মনে হয় আরও গবেষণা প্রয়োজন। দেখার দরকার যে, আসলেই কোন গোষ্ঠী, কোন ব্যক্তি, কোন দেশ কীভাবে জড়িত ছিল। সেগুলো বের করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। কারণ, ষড়যন্ত্রকারী যে দেশে ও বিদেশে ছিল, সে তথ্য আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের অধিকার আছে জানার। আমি বহুদিন ধরে দুটো দাবি জানিয়ে আসছি, একটি হলো— পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন গঠন করা এবং দ্বিতীয়টি হলো— শ্বেতপত্র প্রকাশ করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের চিনিয়ে দেওয়া। সেই কাজটিও হয়নি। হয়নি বলেই ২১ আগস্ট হয়েছিল এবং শেখ হাসিনার ওপর প্রায় কুড়িবার আঘাত হানা হয়েছে। আমার শঙ্কা জাগে, এসব তথ্য যদি আমাদের না জানানো হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে। সুযোগ পেলেই কাজ করবে তারা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আমি মনে করি এমন একটি ঘৃণ্যতম অপরাধের বিচার অনন্তকাল চলার দরকার ছিল। আসলে এটার বিচার শেষ হয় না। আমরা তো বিচারের কিছুই করতে পারিনি। এ ঘটনার অবিরাম বিচার হওয়া উচিত।’
এইউএ/আরএইচ/এমএআর/ ওএফ