ফেসবুক লাইভ থেকে করোনাযুদ্ধের মানবিক গল্প
দেশে করোনা মহামারির বিস্তার শুরু হলে সারাদেশে কোটি কোটি মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েন। বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। চারদিকে যখন মৃত্যুর হাহাকার, ঘরবন্দি ভীতিকর সময়- তখন ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে ‘কানেক্ট দ্য ডটস’ নামের একটি সংগঠনের সূচনা হয় তানভীর শাহরিয়ার রিমনের হাত ধরে।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় এই করপোরেট ব্যক্তিত্ব জানিয়েছেন তার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের অজানা কথা।
যেভাবে শুরু
২০২০ সালের মে মাস। প্রাণঘাতী করোনার আঘাতে আতংকিত শহর থেকে গ্রামের প্রতিটি জনপদ। চট্টগ্রাম নগরে আইসিইউ আর ভেন্টিলেটরের জন্য হাহাকার।
ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১টা। চট্টগ্রামে রিয়াদ খন্দকার নামে এক করোনা আক্রান্ত তরুণের তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। তার এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যরা দিশেহারা। তারা ফোন করেন তানভীর শাহরিয়ার রিমনকে। অনুরোধ করেন একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবস্থা করে দিতে। করোনাকালে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিনে দিনে সোনার হরিণ হয়ে উঠেছে। তার ওপর গভীর রাত। অক্সিজেন কোথায় পাবেন রিমন?
অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু দাম হাকা হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। রিমন বলেন, এই ঘটনাটি আমার মনকে নাড়া দিল। দেশের এমন ক্রান্তিকালে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। অথচ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে অক্সিজেনের দাম আকাশছোঁয়া করে রেখেছেন। খুব মনখারাপ হলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার যাতে অন্তত চট্টগ্রামের কিছু মানুষ সুফল পেতে পারেন। যেন অক্সিজেনের সংকটে অন্তত চট্টগ্রামে কাউকে ভুগতে না হয়।করোনাকালে ঘরবন্দি সময়ে ফেসবুক প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিলাম মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
ফেসবুক লাইভ থেকে করোনাযুদ্ধে
এরপরই ‘কানেক্ট দ্য ডটস’ নামে ফেসবুকে একটি পেজ তৈরি করেন রিমন। শুরু হলো মানবসেবায় পথচলা। এই পেজে ফেসবুক লাইভ করতে শুরু করলেন রিমন।
তিনি বলেন, একেকজন মানুষ এই বিপর্যস্ত সময়ে একেকটা বিন্দু বা ডটস। ‘কানেক্ট দ্য ডটস’র মাধ্যমে এই বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোকে একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করাই আমার লক্ষ্য ছিল। এই লক্ষ্য নিয়েই ফেসবুক লাইভ শুরু করি। তাতে যুক্ত হতে শুরু করেন দেশের নানান সেক্টরের মানুষ। কে কোথায় কী সমস্যায় আছে- সকলেই জানতে শুরু করলেন। একে অপরের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ানো শুরু হলো।
চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দরকার জানতে পেরে রিমন ফেসবুকে একটি লাইভ করেন। সেই লাইভ থেকে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের এমডি এবং সিইও মমিন ইউ ইসলাম অর্থ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। চট্টগ্রামের কর কমিশনার বাদল সৈয়দ, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব, ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপক রুমানা হায়াত, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি বিজয় বসাকসহ রিমনের বহু শুভাকাঙ্ক্ষীদের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে ওঠে বড় অংকের ফান্ড। ফান্ডের অর্থ দিয়ে অক্সিজেন কিনে হস্তান্তর করা হয় চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালে।
করোনার পাশাপাশি গত বর্ষায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অনেক মানুষ। তাদের পাশে দাঁড়াতে চাইলেন তানভীর শাহরিয়ার রিমন।
এই ইচ্ছেকে স্বাগত জানিয়ে লোকসংগীত শিল্পী ইমরান হোসাইন তার শখের উকুলেলে নিয়ে হাজির হন রিমনের ফেসবুক লাইভে। সেই উকুলেলে নিলামে তুলে বিক্রির অর্থ দিয়ে বন্যাকবলিত এলাকায় সহায়তায় দেওয়া হবে- এমন ঘোষণার পর লাইভ চলাকালীন সময়েই প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা অনুদান চলে আসে অবিশ্বাস্যভাবে। যা দিয়ে ইমরানের মেড ইন বাংলাদেশ, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং কানেক্ট দ্য ডটস ফাউন্ডেশনের সমন্বিত পরিচালনায় বন্যাকবলিত ১৫টি জেলায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়।
রিমন জানান, করোনাকালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রিতে অক্সিজেনসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। এছাড়া করোনাযুদ্ধে ফ্রন্টলাইনারদের নিরাপদ রাখতে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গগলস, গ্লাভস ও উন্নতমানের পিপিই সরবরাহ করছেন বিনামূল্যে। এছাড়া নানাভাবে তারা অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
স্বপ্ন বহুদূর
কানেক্ট দ্য ডটসের প্রতিষ্ঠাতা তানভীর শাহরিয়ার রিমন বর্তমানে কর্মরত আছেন দেশের আবাসনখাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান র্যাংকস এফসি প্রোপার্টিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে।
করপোরেটের জনপ্রিয় এ মানবিক মুখ নিজেকে এখনও একজন স্বেচ্ছাসেবক মনে করেন। ঢাকা পোস্টকে রিমন বলেন, আমি শুধু চেয়েছি মানুষের সেবা করব। আমার চাওয়ার স্রোতে ভেলা ভাসিয়ে মানুষই দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে। কেউ অনুদান দিয়ে মানবসেবা করেছেন, কেউ শ্রম দিয়েছেন। কেউবা আমার মনোবল ধরে রাখতে সার্বক্ষণিক সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। আমার স্ত্রী রোকসানা শাহরিয়ার তেমনই একজন। অসাধারণ এই মানুষটি ‘কানেক্ট দ্য ডটস’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে রিমন জানান, চাকরি-জীবন শেষে হলে কানেক্ট দ্য ডটস নামে লাউঞ্জ তৈরি করবেন। যেখানে থাকবে না ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের সঙ্গে কফিতে চুমু দিয়ে মশগুল হবেন আড্ডায়।
এইচকে