আইসিইউ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের লুকোচুরি, রোগীদের হয়রানি
করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের অবস্থা গুরুতর হচ্ছে তাদের জন্য আইসিইউয়ের (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) বিকল্প নেই। তবে চাইলেই আইসিইউ পাওয়া যাচ্ছে না। এর জন্য ঘুরতে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। এভাবে কেউ কেউ হয়তো একটি আইসিইউ পাচ্ছেন। যারা পাচ্ছেন না তারা আর ফিরছেন না ঘরে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক প্রতিবেদনে আইসিইউ নিয়ে যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে তা রীতিমতো বিভ্রান্তিকর। ওই প্রতিবেদনে রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইসিইউ খালি দেখানো হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেও আইসিইউ পাচ্ছেন না রোগীরা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইসিইউ শয্যার তালিকা দেখে ২৬ জুলাই টাঙ্গাইল থেকে রাজধানীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ছুটে আসেন করোনা আক্রান্ত রইস উদ্দিন। কিন্তু সেখানে এসে শোনেন আইসিইউ ফাঁকা নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, কোনো রোগী মারা গেলে বা সুস্থ হলে বেড ফাঁকা হবে। সেই আশায় তাকে নিয়ে হাসপাতালের সামনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেন রইসের সন্তানরা। কিন্তু বেড খালি হয়নি। ডিএনসিসি হাসপাতালের সামনে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পর তাকে নেওয়া হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেও ফাঁকা নেই বেড। এরপর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান রইস উদ্দিন।
রোগীরা বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে আইসিইউ খালি না পেলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর তথ্য দিচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি আছে। এ তথ্যে আরও বিভ্রান্তিতে পড়ছেন রোগীর স্বজনরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রিপোর্টে যে পরিমাণ আইসিইউ খালি আছে বলে উল্লেখ করা হয়, প্রকৃত চিত্র সেরকম নয়। সরকারিভাবে আইসিইউ উপযোগী শয্যাগুলোকে আইসিইউ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে স্বয়ংসম্পূর্ণ আইসিইউয়ের সংখ্যা অনেক কম।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সোমবার (২৬ জুলাই) তথ্য দিয়েছিল, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে মোট ২১২টি আইসিইউ শয্যার ১৮৯টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। খালি রয়েছে ২৩টি আইসিইউ শয্যা। তবে হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় একটি আইসিইউ শয্যাও খালি নেই।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর বললেই তো হবে না। হাসপাতালে তো থাকতে হবে। আমার এই মুহূর্তে একটিও আইসিইউ নেই। আমাদের মূলত ২০৬টা আইসিইউ, পাশাপাশি ট্রায়াজে আরও ৬টি বেড করেছি, যেগুলোতে চাইলে আমরা ভেন্টিলেটর, হাইফ্লো ব্যবহার করতে পারি। হাসপাতালে ইমার্জেন্সি রোগীর সংখ্যা বেশি হলে মাঝেমধ্যে আমরা হাইফ্লো ব্যবহার করি। তবে সবসময় এগুলো পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। তার মানে আমার আইসিইউ মোট ২০৬টা, এর মধ্যে ২০১টা আইসিইউ সকাল ৮টার দিকেই পূর্ণ ছিল, বাকিগুলো ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ভরে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর যদি সকাল ৮টার তথ্যটাও দেয়, তাহলেও তো এত আইসিইউ আমাদের খালি থাকে না। কিন্তু তারা এত সিট কোথায় খালি পেল আমরা জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আইসিইউয়ের অবস্থা এখন মারাত্মক, এখন তো কোনোভাবেই পাবেন না। আমাদের ২/১টা যা ছিল, সকালেই শেষ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে যদি কেউ মারা যায় বা কোনো রোগী সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে হয়তো আইসিইউ খালি হবে।’
নাসির উদ্দীন বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশের করোনা পরিস্থিতির ভয়ংকর অবস্থা। হাসপাতালে আইসিইউ নেই, শয্যাগুলো পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, তারপরও মানুষ আসছেই। এখন হুটহাট একজন রোগী এসে গেলে আমরা কী করব? আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। আমাদের জেনারেল ওয়ার্ডে রোগী নিচ্ছি।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে সাধারণ শয্যা রয়েছে ৫০০টি। ৪৪৬টি শয্যা খালি রয়েছে। তার মানে মাত্র ৫৪ জন রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছেন।
এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক নাসির উদ্দীনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি হাস্যকর। ওরা (স্বাস্থ্য অধিদফতর) সম্ভবত হিসাবটাই বুঝতে পারেনি। এটা নিয়ে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। কালও আমাকে একজন বিষয়টি জানিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো, আমাদের ৫০০টি সাধারণ শয্যা, সেগুলোর মধ্যে দেখাচ্ছে সামান্য কিছু ব্যবহৃত হয়েছে আর বাকিগুলো খালি আছে। কিন্তু বাকি যে আমার আরও ৫০০ শয্যা আছে, যেগুলো হাইকেয়ার এরিয়া (যেগুলোতে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন রয়েছে) সেগুলো তো মোট সংখ্যায় যোগই হয়নি। তারা হয়তো ভুলেই গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল তো এক হাজার বেডের। কিন্তু তারা দেখাচ্ছে ৫০০ বেড। আমাদের ইতিমধ্যে ৫০০ এর ওপরে রোগী ভর্তিই আছে। তাহলে ৫০০ বেডের হাসপাতাল হয় কী করে? এগুলোর বাইরেও আমার ৫০০ বেডের ব্যবস্থা আছে। ওগুলো সব দোকান ছিল। সেগুলোতে চাইলেই আমরা দুটি করে বেড বসাতে পারব, কিন্তু আপাতত একটি করে দিয়েছি। আমরা চাইলে সাধারণ শয্যা আরও বাড়াতে পারব।’
শ্যামলীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালটিও কোভিড ডেডিকেটেড। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এ হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউয়ের মধ্যে ১২টি আইসিইউই খালি রয়েছে। মাত্র চারটিতে রোগী ভর্তি আছে। কিন্তু হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। প্রতিদিনই একটি আইসিইউয়ের প্রত্যাশায় হন্যে হয়ে ঘুরছেন রোগীরা।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আইসিইউসহ ভেন্টিলেটর বা মূলত আইসিইউ বলতে যেটি বুঝায়, সেগুলো আমাদের আছে মাত্র চারটি। এর মধ্যে এই মুহূর্তে একটিও খালি নেই। তবে হাইফ্লো নেজাল ক্যানুলাসহ শয্যা খালি আছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রিপোর্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘তারা যে রিপোর্ট দিচ্ছে, সেটা হয়তো অনেক আগের ছিল। কিন্তু আমাদের হাসপাতাল থেকে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়, সেটা তারা আপডেট করেনি। তাদের তো আমরা প্রতিদিনই আপডেট দিচ্ছি। কিন্তু তারা তাদের প্রতিবেদনে যুক্ত করে না কেন, সেটা তো আর আমরা বলতে পারব না।’
আয়েশা আক্তার বলেন, ‘গতকাল রাতে আমার নিজেরই এক রোগী এসেছিল বরিশাল থেকে, পরে তাকে জেনারেল শয্যায় রাখা হয়েছে। কাল আমি নিজেই অনেক জায়গায় ফোন করেছি। কোথাও শয্যা খালি নেই। সবমিলিয়ে করোনা সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ।’
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও জানায়, রাজধানীর ১৬টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ৭টিতেই কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। ৬টি হাসপাতালে মোট ৪৮টি আইসিইউ শয্যা খালি রয়েছে। সেগুলো হলো- শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল (১টি খালি), রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতাল (৫টি খালি), জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (২টি খালি), শ্যামলী টিবি হাসপাতাল (১২টি খালি), জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (৫টি খালি), ডিএনসিসি ডেডিকেটেড হাসপাতাল (২৩টি খালি)।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বিএম খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনা যে হারে বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা খালি থাকার কথা নয়। তবুও কিছু হাসপাতালে রোগী মৃত্যু ও সুস্থ হওয়ার পর কিছু খালি হচ্ছে, সেগুলোতে নতুন করে ভর্তি হচ্ছে। বলা যায় যে, আইসিইউ শয্যা একটি গতিশীল প্রক্রিয়া, হঠাৎ খালি হচ্ছে, আবার হঠাৎই ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এর সঠিক সংখ্যাটা তুলে আনা কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর মূলত তথ্যটা নিয়ে থাকে আগের দিন সকাল ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত। আর ওই সময়টাতে কিছু আইসিইউ খালি হয়, পরে আবার বেলা বাড়ার সাথে সাথে পূর্ণও হয়ে যায়। তারপরও বিষয়টি আমরা আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখব।’
রাজধানীর অন্যতম কোভিড হাসপাতাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এটির আইসিইউ সংখ্যা অন্য হাসপাতালগুলোর চেয়ে বেশি। ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে গত সাতদিন ধরেই কোনো আইসিইউ শয্যা খালি থাকছে না। তবে হাসপাতালটিতে সাধারণ শয্যা প্রতিদিনই কিছু না কিছু ফাঁকা থাকছে। কিন্তু রাজধানীর বাইরে থেকে আসা গুরুতর রোগীর চাপ বেশি থাকায় আইসিইউ শয্যা ফাঁকাই পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গুরুতর রোগীর স্বজনরাও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা হওয়ার প্রত্যাশায় সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করছেন। আইসিইউয়ে চিকিৎসাধীন কোনো রোগী মারা গেলে অথবা সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হলেই কেবল মিলছে আইসিইউ বেড। ফাঁকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শয্যাটি পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কোনো রোগীর জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ সাপোর্ট লাগলেও তিনি সেটা পাচ্ছেন না।
ওই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে সারা দেশই এখন হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এই ধরনের রোগীর ফুসফুস দ্রুত আক্রান্ত হয় এবং বেশিরভাগ আক্রান্ত রোগীকে সময় মতো চিকিৎসা দিতে না পারলে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আক্রান্ত রোগীদের কেউ কেউ ফুসফুসের ৭০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন। তখন আর কিছু করার থাকছে না। আর ডেল্টায় আক্রান্তদের অক্সিজেন সাপোর্ট বেশি লাগছে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারছে না। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রোগী অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যাচ্ছেন। ঢাকার বাইরের রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টিআই/এনএফ/জেএস