৫ লাখ টাকার ব্যবসায় প্রতিমাসে টার্নওভার ৩০ কোটি টাকা
জাওয়াদ শরীফ, একজন সফল উদ্যোক্তা। দেশের বাইরে থেকে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া জাওয়াদের সুযোগ ছিল দেশে বা দেশের বাইরে মোটা বেতনের চাকরি করার। কিন্তু সে পথে তিনি যাননি, তার তাড়না ছিল নিজে থেকে কিছু করার।
সেই ইচ্ছা থেকেই মাত্র ৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন জাওয়াদ। ৬ বছরের ব্যবধানে এখন জাওয়াদ শরীফের প্রতিমাসেই ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার টার্নওভার হয়। তার প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করছেন তিন শতাধিক লোক।
জাওয়াদ শরীফ বর্তমানে ইউনিভার্সাল অটো নামের একটি বড় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি বি.জে. কারের কার্যনির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে শখের বশে প্রায় ৬ বছর ধরে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলের ইংরেজি সংবাদ পাঠক হিসেবে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন তিনি।
একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে জীবনের গল্প, ব্যবসা শুরুর সময়ের বাধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা, ঘুরে দাঁড়ানো- এমন নানা বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন জাওয়াদ শরীফ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত।
ঢাকা পোস্ট : আপনার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
জাওয়াদ শরীফ : দেশে ফিরে ক্যারিয়ার গঠনে প্রথমে অভিজ্ঞতা বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করি এবং ইউনিভার্সাল অটো নামে সরাসরি জাপান থেকে আমদানি করা ব্র্যান্ড নিউ ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শোরুম দিয়ে যাত্রা শুরু করি। এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে আমি দায়িত্ব পালন করছি। কয়েক বছরেই ইউনিভার্সাল অটো ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে দুটি স্থানে শীর্ষ ১০টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
গাড়ির পাশাপাশি আমরা জাপান থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করছি। চট্টগ্রাম বন্দর এবং মংলা বন্দরে আমাদের স্টাফ আছে। ইউনিভার্সাল অটো নিজেরা ইমপোর্ট করে এনে নিজেরাই কাস্টমারদের হাতে গাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে। এখানে কোনো মিডলম্যান নেই। এছাড়া আমরা অন্যান্য শোরুমগুলোতেও গাড়ি দেই। বর্তমানে আমাদের অনেক বড় টিম রয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক বিভাগ ক্রিয়েট করে সেখানে অনেক ইমপ্লয়রা কাজ করছে।
এছাড়া বি.জে. কারের কার্যনির্বাহী পরিচালক হিসাবেও আমি দায়িত্ব পালন করছি। এই প্রতিষ্ঠানটি গাড়ি আমদানি,পাইকারি, খুচরা বিক্রয় ইত্যাদি সম্বলিত একটি সংঘবদ্ধ বহুজাতিক সংস্থা। জীবনে আমি যেটা জেনেছি সেটা হলো কখনও স্বপ্ন বাস্তবায়নে পিছু হটবেন না। আমি স্বপ্ন দেখতাম একজন সফল বহুজাতিক উদ্যোক্তা হওয়ার।
ঢাকা পোস্ট : আজকের এই অবস্থান তো প্রথম থেকেই ছিল না, এর শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?
জাওয়াদ শরীফ : আমি সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম, পথ যতই ভঙ্গুর হোক না কেন বা পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন, আমাদের সবার শিখতে হবে তা কিভাবে অতিক্রম করতে হয়। আসল বিজয়ীরা হলো তারাই, যারা কখনোই হার মানে না এবং অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।
খুব স্বল্প পুঁজি নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করি। আমার পরিবারের কেউ ব্যবসা করে না, সবাই চাকরিজীবী। আমার মা ছিলেন আর্মির মেজর, বাবা ছিলেন কলেজ শিক্ষক। আমি আমেরিকা থেকে ফিরে একদম ফ্রেশ একজন, কী করবো তখনও জানি না। গাড়ির বিষয়টা আগে থেকেই প্যাশন ছিল আমার। তাই এই অবস্থায় বিষয়টা নিয়েই বাজার পর্যালোচনা শুরু করি। মানুষ কী ধরনের গাড়ি কেনেন, কোন গাড়ি চায়... তখন বাজার যাচাই করে আমি বুঝলাম মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তরা ১৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে এক, দুই কোটি টাকা পর্যন্ত গাড়ি কেনেন। তখন আমার এত পুঁজি ছিল না যে সেই পুঁজি নিয়ে আমি মার্কেটে নামবো।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন চাকরি করে যে টাকা জমাতে পেরেছিলাম সেই মাত্র ৫ লাখ টাকাই তখন আমার মূল পুঁজি। এটাই আমার সম্বল। এই টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করার সাহস করলাম। তখন বারিধারায় ছোট একটি শো রুম ভাড়া নিলাম আমি। এরপর বিভিন্ন ইমপোর্টারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দেই। সত্যি কথা বলতে সে সময় আমি জুতার তলা ক্ষয় করেছি। মানুষের বাসায়, অফিসেসহ বিভিন্ন জায়গায় আমি যেতাম এবং মার্কেটিং করতাম। আমার অ্যাক্টিভিটিজ দেখে বড় বড় ইমপোর্টাররা আমাকে গাড়ি দিতে শুরু করলো সেল করার জন্য। এভাবে কিছুটা এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। এরপর লোকালি পারচেজ করা শুরু হয় আমার। বিষয়টা এমন, একজন কেউ গাড়ি নিয়ে এসেছে আমি বিক্রি করে দিয়েছি। আমি তখন চিন্তা করলাম আমার কোম্পানি বা ব্যবসার প্রসার হচ্ছে, বিক্রি বাড়ছে, তখন নিজেই চিন্তা করলাম আমাকে আরও এগিয়ে যেতে হবে।
ততদিনে আমার সঞ্চয় করা টাকা দিয়ে অর্থাৎ এতদিন ব্যবসা করে যে টাকাগুলো আমি জমা করেছি এর সঙ্গে আরও কিছু ম্যানেজ করে নিজে অল্প পরিসরে গাড়ি ইমপোর্ট করা শুরু করলাম। সেই ৫ লাখ টাকায় শুরু করেছিলাম, এখন আমার প্রতিমাসে আল্লাহর রহমতে ২০ থেকে ৩০ কোটি টার্নওভার আসে। ২০১৫ সালে থেকে ২০২১ সাল এই ৬ বছরের মধ্যে এই পরিবর্তন।
ঢাকা পোস্ট : এমন সফলতার পেছনে নিজের কোন ধরনের বিষয়গুলো বেশি ভূমিকা রেখেছে?
জাওয়াদ শরীফ : শূন্য থেকে শুরু করে, প্রতিকূল পথ ধরে তরুণ একজন আমি সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে, কঠোর পরিশ্রম এবং সত্য নিষ্ঠার সঙ্গে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে লক্ষ্য অর্জন করেছি। ভিন্ন ধারার দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করার চেষ্টা এবং একটি শক্তিশালী তথ্য কাঠামো তৈরি করে তরুণ উদ্যোক্তাদের তাদের নিজ ক্ষমতায় সাফল্যের পথ দেখাতে চেয়েছি। সর্বদা জনসাধারণকে সাহায্য করতে চেয়েছি, দেশ ও জনগণের জন্য কিছু করতে এবং আর্থ-সামাজিক প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নে অবদান রাখতে চেয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : ব্যক্তিগত এবং আপনার একাডেমিক বিষয় সম্পর্কে সাধারণ পাঠকদের পক্ষ থেকে একটু জানতে চাই।
জাওয়াদ শরীফ : চাকরিজীবী বাবা-মা এবং দুই ভাইয়ের পরিবারে বেড়ে ওঠা আমি সর্বদা নিজের সাম্রাজ্য গড়ার তাগিদে অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। রাজধানীর নামকরা রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এসএসসিতে সর্বোচ্চ রেজাল্ট নিয়ে পাস করেছিলাম। শিক্ষাজীবনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য বিভাগীয় কেনেডি-লুগার ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ এবং স্টাডি (ইয়েস) প্রোগ্রামের জন্য একজন তরুণ রাষ্ট্রদূত নির্বাচিত হয়েছিলাম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাইভারসিফাইড পপুলেশনের মধ্যে বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেছি। পরে কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের লিমন হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা শেষ করি। পরবর্তীতে কলোরাডো স্কুল অব মাইনস থেকে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় সারফেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অর্জন করি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আমিই প্রথম বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসাবে সভাপতি নির্বাচিত হই এবং টানা দুই বছর ওই পদে ছাত্র পরিষদে দায়িত্ব পালন করেছি।
ঢাকা পোস্ট : অটো ইন্ডাস্ট্রিতে একটি দুর্দান্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করলেও, আমরা জানি আপনি একজন ইংরেজি সংবাদ পাঠক হিসাবে কাজ করছেন। এই বিষয়ে একটি একটু জানতে চাই।
জাওয়াদ শরীফ : এই বিষয়টা পুরোপুরিই শখের বশে। একজন সফল সংবাদ পাঠক হিসাবে নিচের পদচিহ্ন স্থাপন করতে চেয়েছি। বর্তমানে এনটিভিতে ইংরেজি সংবাদ পাঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি, এর আগে আমি এটিএন নিউজে একই পদে দায়িত্ব পালন করতাম।
আমেরিকায় স্টুডেট জার্নালিজমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম ছাত্র থাকাকালীন। ক্যাম্পাস রিপোর্টার হিসেবে সেসময় কাজ করেছি। সে থেকেই এর প্রতি একটা ভালোবাসা। এটিএন নিউজের পর এনটিভিতে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে সাড়ে ৪ বছর ধরে কাজ করছি।
ঢাকা পোস্ট : আপনার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কত সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
জাওয়াদ শরীফ : বর্তমানে আমার এই প্রতিষ্ঠানে তিন শতাধিক লোক কাজ করছেন। সবার তত্ত্বাবধানে একটি ঐক্যবদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে, সর্ব সমতায় আমি বিশ্বাস করি বলে আমার প্রতিষ্ঠানে পক্ষপাতিত্বের কোনো স্থান নেই। আমি অনেক তরুণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নানা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি, অনেকের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে সহায়তা করেছি।
ঢাকা পোস্ট : উচ্চ শিক্ষিত একজন চাকরির দিকে না এগিয়ে উদ্যোক্তা হতে চাওয়ার বিষয়ে পারিবারিক কোনো বাধা ছিল কি না?
জাওয়াদ শরীফ : বাবা-মা সহ আমার পুরো পরিবারটা চাকরিজীবী। তবুও আমি ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা হয়েছি। তবে আমি কাজ শুরুর সিদ্ধান্তের পর আমার বাবা-মা আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন, পাশে ছিলেন। কিন্তু আশপাশের মানুষ, সমাজ, আত্মীয়-স্বজন প্রথমে নেতিবাচকভাবেই নিয়েছিল। চাকরিজীবী পরিবারের সন্তান হয়ে আমি কেন উদ্যোক্তা হচ্ছি এসব বিষয়ে। আমাদের দেশে কেউ কোনো উদ্যোগ নিতে গেলে আশপাশের মানুষ খুব নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু আমি পারবো, করবো এমন ঝুঁকি নিয়ে শুরু করেছিলাম বলে কিন্তু আমি বের হয়ে আসতে পেরেছি, আজকের অবস্থানে এসেছি।
ঢাকা পোস্ট : বর্তমানে অনেকেই নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে কোনো পরামর্শ?
জাওয়াদ শরীফ : এটা ঠিক, সময় বদলেছে। এখন অনেকই উদ্যোক্তা হতে চান। বেকারত্ব আমাদের দেশের জন্য একটি অভিশাপ। তাই একজন সফল উদ্যোগী হওয়ার মন মানসিকতা আগে থাকতে হবে আমাদের। যে কোনো উদ্যোগের জন্য সে বিষয়ে আগে ভালোভাবে জানতে হবে। ডিপ্লোমা বা সেই বিষয়ে কোনো কোর্স থাকলে তা করে সেসব বিষয় সম্পর্কে উদ্যোক্তাদের আগে জানতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো। আমাদের কিন্তু অনেক শ্রমিক আছে, কিন্ত তাদের মধ্যে কিন্তু সেই অর্থে কর্মদক্ষতা নেই। এই কর্মদক্ষতা সব ক্ষেত্রেই বাড়ানো জরুরি। ইচ্ছে, পরিশ্রম, সততা একজন মানুষকে অনেক দূরে এগিয়ে নিতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : শত ব্যস্ততার মাঝে ঢাকা পোস্টকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জাওয়াদ শরীফ : ঢাকা পোস্টকেও অনেক ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা।
এএসএস/এনএফ