ধুঁকছে চট্টগ্রামের শেষ দুই সিনেমা হল
সিনেমা হলে আগের জৌলুশ নেই। চট্টগ্রামে একসময় ৩৫টি সিনেমা হল থাকলেও বর্তমানে টিকে আছে মাত্র দুটি। ভালো মানের চলচ্চিত্র তৈরি না হওয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল ও অ্যাপসের মাধ্যমে ঘরে বসে পছন্দের ছবি দেখার সুযোগ থাকায় হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আগ্রহ কমে গেছে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবুও ঈদ এলেই নড়েচড়ে বসেন চট্টগ্রামে চালু থাকা সুগন্ধা ও সিনেমা প্যালেস হল মালিকরা। কারণ শুধু এই ঈদই এখন হলগুলোর আয়ের প্রধান উপলক্ষ। কিন্তু সেই উপলক্ষেই হল মালিকরা চরমভাবে মার খেলেন টানা দুই বছর। টানা দুই ঈদই তাদের কাটাতে হচ্ছে হলে তালা ঝুলিয়ে। লাভের মৌসুমেই লোকসান গুনছেন হলমালিকরা। এছাড়া করোনার কারণেও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ সিনেমা হলগুলো।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সুগন্ধা ও সিনেমা প্যালেস সিনেমা হলের পরিচালক সাইফ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমনিতে সিনেমা হলের ব্যবসা মন্দা। তারপর করোনার কারণে দুই বছর ধরেই বন্ধ সিনেমা হলগুলো। করোনার মাঝে কিছুদিন চালু থাকলেও দর্শক আসেনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের কোনো আয় নেই। কিন্তু প্রতি মাসেই স্টাফদের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে ৬০-৭০ হাজার টাকা। এভাবে চলতে থাকলে আমাদেরও বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, করোনা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তাহলে সিনেমা হল চালু রাখা সম্ভব না। আমাদেরও হয়ত অন্য কিছু চিন্তা করতে হবে। সরকার একদিকে বলছে সিনেমা হল বাঁচাতে। সিনেমা হল বাঁচাতে হলে খোলা রাখতে হবে। আমি মনে করি সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সিনেমা হল অনেক আগের। এগুলো বন্ধও করতে পারছি না। ঝুমুর সিনেমা হল ভেঙে নতুন করে কাজ করে সুগন্ধা নাম দিয়ে চালু করেছি। অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছি। কিন্তু চালুর পরপরই করোনা শুরু হয়। ফলে লোকসানে পড়তে হয়েছে। সিনেমা হল চালু রাখতে এখন জমানো টাকা খরচ করে স্টাফদের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ চালাতে হচ্ছে।
সাইফ হাসান বলেন, সরকার থেকে কোনো সাহায্য বা প্রণোদনা পাইনি। এই পর্যায়ে এসে আমাদের ট্যাক্স যদি মওকুফ করে দিত তাহলেও একটা সাপোর্ট পেতাম।
সিনেমা হল টিকে আছে দুটি
চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র চর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলো তৈরি হতে থাকে। ৭০ এবং ৮০-র দশকেও চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলোতে সগৌরবে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে ৯০ দশকের শেষ দিকে এসে সিনেমা হলগুলোতে দর্শক সংখ্যা কমতে থাকে। দর্শকের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে সিনেমা হল।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে একসময় ৩৫টির মতো সিনেমা হল ছিল। হলের এমন সংখ্যাই বলে দেয় এখানে কেমন ছিল চলচ্চিত্র ব্যবসা। কিন্তু সেসব এখন সোনালী অতীত। বর্তমানে কমতে কমতে সেই সংখ্যা নেমেছে দুইয়ে। চালু হলগুলোর অবস্থাও তেমন ভালো নয়।
বন্ধের তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে ১৯৬৫ সালে যাত্রা করা আলমাস ও দিনার সিনেমা হল দুটি। গত বছরের ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা হল দুটি। আর দুই বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে পূরবী সিনেমা হল। এর আগে বন্ধ হয়েছে সাগরিকা, বনানী, সানাই,আকাশ, রঙ্গম, নূপুর, চাঁদনী, কর্ণফুলী, উজালা। এছাড়াও বন্ধ হয়ে গেছে, সীতাকুণ্ডের পরাগ, ফটিকছড়ির ঝংকার, পটিয়ার ছন্দা ও সবুজ।
ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘির খুরশিদ মহল সিনেমা হল ভেঙে তৈরি হয়েছে মহল মার্কেট, স্টেশন সড়কের উজালা সিনেমা হল ভেঙে করা হয়েছে এশিয়ান এসআর হোটেল, আগ্রাবাদের বনানী সিনেমা হল ভেঙে করা হয়েছে বনানী কমপ্লেক্স, নিউমার্কেটের জলসা সিনেমা হলে হয়েছে জলসা মার্কেট। এভাবে লায়ন, গুলজার, নূপুর ও রঙ্গম সিনেমা হল ভেঙেও করা হয়েছে বহুতল মার্কেট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো মানের চলচ্চিত্র তৈরি না হওয়ায় দর্শকরা হলে আসছেন না। এছাড়া স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে ঘরে বসে পছন্দের ছবি দেখার সুযোগ থাকায় হলে সিনেমা দেখার আগ্রহ কমে গেছে। দর্শকদের সিনেমা হলমুখী করতে হলে ভালো মানের চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে, ভালো মানের চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ভালো মানের সিনেমা হলের সংকটকেও চলচ্চিত্র ব্যবসার কমে আসার জন্য দায়ী করছেন দর্শকরা।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের সভাপতি শৈবাল চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রামে একসময় ৩৫টি সিনেমা হল ছিল। এখন কমতে কমতে তা দুটিতে এসেছে। করোনার কারণে এইগুলোও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে।
সিনেমা হল বন্ধের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভালো চলচ্চিত্র পাচ্ছে না সিনেমা হলের মালিকরা। দর্শকরাও হলমুখী হচ্ছে না। তারা বিভিন্ন অ্যাপসে ছবি দেখেন। এছাড়া ইউটিউব, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ঘরে বসেই সিনেমা দেখতে পারেন। টেলিভিশনগুলোতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ছবি দেখাচ্ছে। এসব কারণে মানুষ হলমুখী হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ভালো সিনেমা ও দর্শক না পাওয়ার কারণে সিনেমা হলগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি দীর্ঘদিন। ফলে সিনেমা হলের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আসন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভালো প্রজেকশন সিস্টেম ছিল না, সাউন্ড সিস্টেম ভালো ছিল না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল না হলগুলো। ফলে হলগুলো একটি গুদামের মতো অবস্থা হয়েছিল। মানুষজন টাকা খরচ করে এই অবস্থায় সিনেমা হলে কেন যাবে? তাই দর্শক হলবিমুখ হয়ে যান। হলগুলোতে দর্শক ফেরাতে হলে ভালো মানের ছবি তৈরির পাশাপাশি হলের ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতির কারণেও হলগুলো চালু করা যাচ্ছে না। ঈদের সময় মোটামুটি দর্শকরা হলমুখী হলেও গত দুই বছর ধরে করোনার কারণে তা বন্ধ। ফলে সিনেমা হলের মালিকরা লোকসানে পড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে যে দুটি সিনেমা হল চালু আছে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। হল বাঁচিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।
চট্টগ্রামে সিলভার স্ক্রিন নামে একটি সিনেপ্লেক্স চালু হয়েছে ২০১৮ সালে। করোনার কারণে বন্ধ থাকায় এটিও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কেএম/এইচকে