যেসব ভুলে ই-পাসপোর্ট পেতে দেরি
আবেদনের পর সঠিক সময়ে পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ার অভিযোগ অনেক দিনের। বর্তমান ই-পাসপোর্ট যুগেও একই অভিযোগ শুনতে হয় সংশ্লিষ্টদের। সাধারণ আবেদনের ক্ষেত্রে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা, কিন্তু অনেক সময় দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও সেই কাঙিক্ষত ‘বস্তু’ হাতে আসে না।
আবার অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হয়। ডেলিভারির নির্দিষ্ট তারিখের আগেই হাতে পৌঁছে যায় পাসপোর্ট। এ বিলম্বের জন্য কি শুধু পাসপোর্ট অধিদপ্তর দায়ী নাকি আবেদনকারীরও দায় থাকে?
সম্প্রতি সরেজমিন বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, অনুসন্ধান কেন্দ্রের বাইরে ভিড় করছেন অনেকে। অধিকাংশেরই একই প্রশ্ন, ‘পাসপোর্ট কবে পাব?’
প্রতিদিন কত লোক পাসপোর্ট সংক্রান্ত তথ্যের জন্য আসে তার কোনো হিসাব নেই অধিদপ্তরের তথ্য অনুসন্ধান কেন্দ্রে। তবে দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ লোককে নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরন। সেসব কর্মকর্তারা জানান, প্রায় ৮০ ভাগ অনুসন্ধানই পাসপোর্ট ডেলিভারি সংক্রান্ত। অনেকের পাসপোর্টের ডেলিভারি ডেট পার হয়ে গেলেও কেন তারা মেসেজ পাচ্ছেন না তার কারণে জিজ্ঞাসা করছেন।
অধিদপ্তরের বাইরে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন ই-পাসপোর্ট আবেদনকারী। তিনি বলেন, আমি গত ১৮ অক্টোবর ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি। আবেদনের ৭ দিন পর আমার পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হয়। নভেম্বরের ১২ তারিখ পাসপোর্ট পাওয়ার কথা থাকলেও আমি কোনো মেসেজ পাইনি। এমনকি ডিসেম্বর মাস পর্যন্তও না। ভেরিফিকেশন করা পুলিশ সদস্যকে ফোন দিলে জানতে পারি তিনি সময়মতই আমার বিষয়ে ইতিবাচক রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। অনলাইনে স্ট্যাটাস দেখতে গেলে দীর্ঘদিন ধরে ‘পেন্ডিং ফর পাসপোর্ট পার্সোনালাইজেশন’ দেখাচ্ছে।
ইসমি আজাদ নামে আরেক আবেদনকারী বলেন, আমি গত ৩ মাস আগে পাসপোর্ট আবেদন করেছিলাম। এখনও পাসপোর্ট অনুমোদিত হয়নি। পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার পরেও এখনও পাসপোর্ট হাতে পাইনি।
পাসপোর্টের বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী বলেন, ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত মোট এক লাখ ৪০ হাজার ই-পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর থেকে দেশের সব পাসপোর্ট অফিসে ই-পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে আমরা ই-পাসপোর্ট এবং এমআরপি উভয়ই দিচ্ছি। যারা যেটা চাচ্ছে তারা সেটাই পাচ্ছে। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকের পাসপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে। এর অবশ্য কারণও আছে। অনেক সময় পুলিশি প্রতিবেদনের কারণে পাসপোর্ট দিতে দেরি হয়। আবার অনেকে নিজের নামের সঙ্গে বিএসসি, পিএসসিসহ নানা পদবী জুড়ে দেন। একারণে সফটওয়ারে সেই আবেদনগুলো পড়ে থাকে। এছাড়াও অনেকের নামের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধনে দেওয়া নামের মিল না থাকায় অনেক সময় পাসপোর্ট পাওয়া যায় না।
যে কারণে পাসপোর্টে বিলম্ব: নামের ভুল
পাসপোর্ট ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, অনেকেই পাসপোর্টের বিলম্বের কথা বলেন কিন্তু কারণগুলো জানার চেষ্টা করেন না। প্রথমত, পাসপোর্ট আবেদনের সময় অনেকেই ‘গিভেন নেইম ও সারনেইম’ নিয়ে গুলিয়ে ফেলেন। কারো নাম যদি ৩-৪ শব্দের মধ্যে তার নামের প্রথম অংশগুলো গিভেন নেইমে ও শেষের একশব্দ সারনেইমে দিতে হবে। তবে অনেকেই ৪ শব্দের নামে গিভেন নেইমে দুই শব্দ ও সারনেইমে ২ শব্দ দেন। একারণে পাসপোর্ট ইস্যু হয় না।
এনআইডির সঙ্গে আবেদনপত্রের নাম-ঠিকানায় অমিল
অনেক আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) নামের বানানে অমিল থাকে। পাসপোর্ট করতে হলে এনআইডি জমা দিতে হয়। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সঙ্গে এনআইডির সার্ভার সংযুক্ত। যদি আবেদনপত্রের নাম ও এনআইডির নামের বানানে অমিল থাকে তাহলে ওই পাসপোর্ট আর ইস্যু হয় না। সেক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করে আবারও আবেদন করতে হয়।
নামের সঙ্গে পদবি যুক্ত
অনেকে নামের নামের সঙ্গে বিএসসি, পিএসসি, পিপিএম, এমডি ইত্যাদি টাইটেল যুক্ত করেন। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে এগুলো থাকে না। তাই এসব টাইটেল পাসপোর্টের আবেদনপত্রে উল্লেখ করলে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট ইস্যু করা সম্ভব হয় না। এসব টাইটেল বাদ দিয়ে আবার আবেদন করলে পাসপোর্ট পাওয়া যায়।
পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদনের বিলম্ব
নতুন পাসপোর্টের করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশন। প্রতিটি পাসপোর্ট অনুমোদন পাওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ইতিবাচক তদন্ত প্রতিবেদন। পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলছে, পুলিশ প্রতিবেদন পেতে দেরি হওয়ার কারণে বর্তমানে ই-পাসপোর্ট ইস্যু করতে কিছুটা সময় লাগে। একটি সাধারণ পাসপোর্টের আবেদনের ৭ দিনের মধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাঝে মধ্যে প্রতিবেদন দিতে মাসখানেকের বেশি সময় লেগে যায়।
এ বিষয়ে নাম গোপন রাখার শর্তে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতিবেদন বিলম্বে বা দ্রুত দেওয়ার কোনো বিষয় নয়। একজন তদন্ত কর্মকর্তা যতক্ষণ পর্যন্ত তার বিষয়ে তথ্য নিশ্চিত না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি প্রতিবেদন দেবেন না, এটাই নিয়ম। একজন তদন্ত কর্মকর্তাকে বর্তমান ঠিকানার পাশাপাশি গ্রামে স্থায়ী ঠিকানায় দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গেও সমন্বয় করতে হয়। সবমিলে একটু সময় লেগে যায়।’
এমআরপি থাকলে নির্ধারিত সময়ের আগেই পাওয়া যাচ্ছে ই-পাসপোর্ট
পাসপোর্ট অধিদপ্তরে যেসব আবেদনকারী এমআরপি থেকে ই-পাসপোর্টে রূপান্তরের জন্য আবেদন করেছিলেন, তারা নির্ধারিত সময়ের আগেই ই-পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন।
জাহানারা বেগম নামে একজন আবেদনকারী জানান, তার এমআরপি পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। তিনি নভেম্বরের ১৮ তারিখ এমআরপি থেকে ই-পাসপোর্টে রূপান্তরের জন্য আবেদন করেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান ২ ডিসেম্বর। ২৩ ডিসেম্বর তারিখে তার ডেলিভারি ডেট থাকলেও ১৩ ডিসেম্বর তিনি পাসপোর্ট ইস্যু হওয়ার ম্যাসেজ পান। পরদিন অধিদপ্তরে গিয়ে হাতে পান পাসপোর্ট।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতে আসা কমপক্ষে ১৩ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগেও ই-পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন।
আগারগাওয়ের পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বর্তমান অবস্থা
আগে আগারগাওয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আশপাশে দালালের দৌরাত্ম থাকলেও বর্তমান চিত্র অনেকটাই পরিবর্তিত। অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, গেটের বাইরে পাসপোর্ট করে দেওয়ার মতো কোনো দালাল নেই। উত্যক্ত করার কেউ নেই। অধিদপ্তরের বাইরে ৫-৬টি ব্যানার লাগানো হয়েছে। ব্যানারে ৪০ জন দালালের ছবি দিয়ে তাদের দেখলেই ধরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। দালাল না থাকলেও গেটের বাইরে ৩-৪ জন মহিলার উপস্থিতি দেখা যায়। যারা ফরমে ছবি ও টাকার রশিদ লাগানোর জন্য স্ট্যাপলার-আঠা নিয়ে ঘোরাঘুরি করে।
মূল গেটের ভেতরে প্রতিটি ফ্লোরে গিয়ে কোনো দালালের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। সবাইকে স্বাচ্ছন্দ্যে আবেদন করতে দেখা গেছে।
চালু থাকছে এমআরপি কার্যক্রম
দেশে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ কোটি ৪ হাজার এমআরপি ইস্যু করা হয়েছে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী বলেন, দেশে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম চলমান থাকলেও চালু থাকছে এমআরপি। দেশের যে কোনো নাগরিক কমপক্ষে ৩৪৫০ টাকা দিয়ে এমআরপির জন্য আবেদন করতে পারবেন। যার যেটা ইচ্ছা সেটা নিতে পারবেন। বর্তমানে এমআরপির বইয়ের মজুদ কিছুটা কমে গেছে। শিগগিরই আমরা নতুন করে আরও বই আনবো।
পাসপোর্টের ফি: ই-পাসপোর্ট
৫ বছর মেয়াদের ৪৮ পাতার ই-পাসপোর্ট ‘রেগুলার ডেলিভারি’ ক্যাটাগরিতে ১৫ কার্যদিবসের পেতে ৪০২৫ টাকা, ‘এক্সপ্রেস ডেলিভারি’তে সাত কার্যদিবসে পেতে ৬৩২৫ টাকা এবং ‘সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি’তে ২ কার্যদিবসের মধ্যে পেতে ৮৬২৫ টাকা জমা দিতে হবে। তবে আবেদনকারীকে সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারির আবেদন করতে হলে আবেদনের আগেই নিজ দায়িত্বে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিতে হবে।
১০ বছর মেয়াদের ৪৮ পাতার ই-পাসপোর্ট ‘রেগুলার ডেলিভারি’ ক্যাটাগরিতে ১৫ কার্যদিবসের পেতে ৫৭৫০ টাকা, ‘এক্সপ্রেস ডেলিভারিতে সাত কার্যদিবসে পেতে ৮০৫০ টাকা এবং ‘সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি’তে ২ কার্যদিবসের মধ্যে পেতে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা জমা দিতে হবে।
৫ বছর মেয়াদের ৬৪ পাতার ই-পাসপোর্ট ‘রেগুলার ডেলিভারি’ ক্যাটাগরিতে ১৫ কার্যদিবসের পেতে ৬৩২৫ টাকা, ‘এক্সপ্রেস ডেলিভারি’তে সাত কার্যদিবসে পেতে ৮৬২৫ টাকা এবং ‘সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি’তে ২ কার্যদিবসের মধ্যে পেতে ১২ হাজার ৭৫ টাকা জমা দিতে হবে।
১০ বছর মেয়াদের ৬৪ পাতার ই-পাসপোর্ট ‘রেগুলার ডেলিভারি’ ক্যাটাগরিতে ১৫ কার্যদিবসের পেতে ৮০৫০ টাকা, ‘এক্সপ্রেস ডেলিভারিতে সাত কার্যদিবসে পেতে ১০৩৫০ টাকা এবং ‘সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারিতে ২ কার্যদিবসের মধ্যে পেতে ১৩ হাজার ৮০০ টাকা জমা দিতে হবে।
এছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদের নতুন অথবা রি-ইস্যু এমআরপি ৭ দিনে পেতে ৬৯০০ টাকা ও ২১ দিনে পেতে ৩৪৫০ টাকা দিতে হবে। এমআরপি ও ই-পাসপোর্ট উভয় ফি'র সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীরা রেগুলার ডেলিভারির জন্য আবেদন করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারা এক্সপ্রেস ডেলিভারির সুবিধা পাবেন।
এআর/এসএম