যানজটে নাকাল ঢাকাবাসী, করপোরেশনের ‘ধীরগতি’
রাজধানীর যানজটে অতিষ্ঠ হওয়ার মাত্রাটা দিনদিন যেন বেড়েই চলছে। বিশ্ব ব্যাংকের এক জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
যানজট নিরসনে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এখনও কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী।
যানজট নিরসনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেগুলোর কোনোটি এখনও শেষ হয়নি। খুব ধীরগতিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তাদের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে ধারণা করা যায় যানজট কিছুটা হলেও কমে আসবে।
সর্বশেষ সভাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঢাকার ঘাটারচর হতে মতিঝিল পর্যন্ত যেখানে ১৬০টির বেশি বাস ও ২৯ জনের বেশি মালিকের বাস চলাচল করে, সেটিকে আমরা একটি কোম্পানির মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছি
মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
বাসরুট রেশনালাইজেশন সংক্রান্ত কমিটি
সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে আহ্বায়ক করে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো ও যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটিতে ডিএনসিসির মেয়রকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, রাজউক চেয়ারম্যান, ডিএমপি কমিশনার, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক। কমিটি এখনও রয়েছে তবে পদাধিকার বলে কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বর্তমান এ কমিটি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমেও রয়েছে ধীরগতি।
আমরা ইতোমধ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমরা পুরো গণপরিবহন ব্যবস্থাকে এটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চাই
মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
চক্রাকার বাস
এর আগে সাঈদ খোকন মেয়র ও কমিটির আহ্বায়ক থাকাকালীন যানজট নিরসনে এবং সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে ধানমন্ডি-নিউ মার্কেট-আজিমপুরে চক্রকার বাস চালু করেন। যদিও এ পদক্ষেপ আশানুরূপ কোনো ফল দেয়নি। এরপর রাজধানীর উত্তরায় চক্রকার বাস চালু হয়। সার্ভিসটি নিয়ে পরবর্তীতে নানা ঝামেলা তৈরি হয়।
এছাড়া মতিঝিলসহ আরও কয়েকটি পৃথক রুটে চক্রকার বাস সার্ভিস চালু হওয়ার কথা রয়েছে। জানা গেছে, সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য শহরের বাস শহরের ফ্র্যাঞ্চাইজি রুট দিয়ে চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১ এপ্রিল থেকে ঘাটারচর-মতিঝিল রুটে প্রথম রুট ফ্রেঞ্চাইজ রুট শুরু হতে যাচ্ছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতির বিষয়ে কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ সভাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঢাকার ঘাটারচর হতে মতিঝিল পর্যন্ত যেখানে ১৬০টির বেশি বাস ও ২৯ জনের বেশি মালিকের বাস চলাচল করে, সেটিকে আমরা একটি কোম্পানির মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছি।
আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল
গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ হিসেবে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল হিসেবে ঢাকা মহানগরীর শহরতলির চারটি স্থানকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। স্থানগুলো হচ্ছে- বিরুলিয়ার বাটুলিয়া, সাভারের হেমায়েতপুর, তেঘরিয়া ও কাঁচপুর।
বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটির কাছে কারিগরি কমিটি কর্তৃক আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও ডিপোর জন্য প্রস্তাবিত ১০টি স্থানের মধ্যে এই চারটি স্থান নির্ধারণ করেছে।
বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরের বাইরের বাস ঢাকার মধ্যে ঢুকতে পারবে না। কারণ এখন শহরের বাসের সঙ্গে আন্তঃজেলা বাসের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এতে কিন্তু আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, ট্রাফিক জ্যাম হচ্ছে। তাই শহরের বাসকে শহরের ভেতরে চলতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট রুটের মধ্যে চলতে হবে
মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
বাসরুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ হিসেবে কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস্তবায়ন হলে অন্যান্য জেলার বাসগুলো ঢাকা শহরের মধ্যে ঢুকতে পারবে না। শহরের বাস শহরের ভেতরে চলবে আর শহরের বাইরের বাস অর্থাৎ আন্তঃজেলা বাস একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থেমে যাবে। বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরের বাইরের বাস ঢাকার মধ্যে ঢুকতে পারবে না। কারণ এখন শহরের বাসের সঙ্গে আন্তঃজেলা বাসের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এতে কিন্তু আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, ট্রাফিক জ্যাম হচ্ছে। তাই শহরের বাসকে শহরের ভেতরে চলতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট রুটের মধ্যে চলতে হবে।
বাসরুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগুলো এগিয়ে নিতে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল হিসেবে ঢাকা মহানগরীর শহরতলির চারটি স্থান পরিদর্শন করেছেন কমিটির প্রধান ও ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমরা পুরো গণপরিবহন ব্যবস্থাকে এটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চাই। আমরা এরই মাঝে কাজ আরম্ভ করেছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত সভাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের জন্য যে ১০টি স্থানকে নির্বাচন করা হয়েছে, সেখান থেকে আমরা তালিকা ছোট করে এনেছি। আমরা মনে করছি, সার্বিকভাবে চারটি স্থান গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
যানজট নিরসনে ইউটার্ন নির্মাণ
যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) তেজগাঁও সাতরাস্তা হতে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে আর্মি গলফ ক্লাব সংলগ্ন স্থানের ইউটার্নটি প্রথম সংশোধনী প্রকল্পে বাতিল করা হয়। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এ উদ্যোগ গ্রহণ করলেও দীর্ঘসময় এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে এ কাজ পুনরায় চালু হলেও এখন পর্যন্ত মোট ছয়টি ইউটার্ন চালু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর তিনটি ইউটার্ন চালু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ইউটার্নগুলো হচ্ছে- তেজগাঁও বিজি প্রেসের সামনে, নাবিস্কো-কোহিনুর কেমিক্যাল মোড় এবং বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি। এনিয়ে মোট ছয়টি ইউটার্ন চালু করা হয়েছে। ইতোপূর্বে খুলে দেওয়া অন্য তিনটি ইউটার্ন হচ্ছে- কাওলা ফ্লাইং একাডেমি, উত্তরা র্যাব-১ কার্যালয়ের সামনে এবং উত্তরা জসিম উদ্দিন মোড়।
যানজট নিরসনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেগুলোর কোনোটি এখনও শেষ হয়নি। খুব ধীরগতিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তাদের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে ধারণা করা যায় যানজট কিছুটা হলেও কমে আসবে
যদিও ইউটার্নগুলো চালু হওয়ার পর তেমন সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। অবশিষ্ট চারটি ইউটার্নের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এ চারটি ইউটার্ন হচ্ছে- মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের সামনে, মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে, বনানী-কাকলী রেলস্টেশন এবং বনানী ফ্লাইওভারের নিচে।
প্রকল্পের শুরুতে মোট ১১টি ইউটার্ন নির্মাণ করার পরিকল্পনা থাকলেও আর্মি গলফ ক্লাব সংলগ্ন স্থানের ইউটার্নটি প্রথম সংশোধনী প্রকল্পে বাতিল করা হয়। প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ২৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ছিল। তবে প্রথম সংশোধিত প্রাক্কলিত ব্যয় ৩১ কোটি ৮০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ইউটার্নে মিলছে না সুফল, যা বলছে কর্তৃপক্ষ
ইউটার্নগুলো চালু হওয়ার পর তেমন কোনো সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী— এমন অভিযোগ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের। তিনি বলেন, আমরা মোট ১০টি ইউটার্ন নির্মাণ করব। ইতোপূর্বে তিনটি ইউটার্ন নির্মাণ করা হয়েছে, সম্প্রতি আরও তিনটি ইউটার্ন খুলে দেওয়া হয়েছে। আরও চারটি নির্মাণাধীন। সবগুলো ইউটার্ন চালু হলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
আমাদের সবগুলো ইউটার্নের নির্মাণকাজ শেষ হলে অবশ্যই তখন নগরবাসী সুফল পাবেন। সবগুলোর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুরোপুরি সফলতার বিষয়ে বোঝা যাবে না। নির্মাণকাজ শেষে যখন সবগুলো একসঙ্গে চালু হবে তখন অবশ্যই যানজট অনেকাংশে কমে আসবে— দাবি মেয়র আতিকুল ইসলামের।
এএসএস/এমএআর/